1. admin@mannanpresstv.com : admin :
গল্প -নদী যখন কাঁদে -সুনির্মল বসু - মান্নান প্রেস টিভি
রবিবার, ০৭ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৯:৪৫ পূর্বাহ্ন

গল্প —নদী যখন কাঁদে –সুনির্মল বসু

এম.এ.মান্নান.মান্না
  • Update Time : মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ, ২০২৪
  • ২৫৫ Time View
মানুষের জীবনে চলার পথে প্রতিদিন কত স্মৃতি জমা হয়। নৈমিত্তিক ব্যস্ততায় অনেকের পক্ষে সেসব মনে রাখা সম্ভব হয়না। অনেকে আবার বেদনার স্মৃতি গুলো মনে রাখতে চান না। কি হবে খুঁচিয়ে ঘা করে!
আজ আমি আমার এক বাল্যবন্ধুর কথা শোনাবো, বর্তমানে সে একটা কর্পোরেট হাউসের অধিকর্তা। তাঁর বর্তমান স্ট্যাটাসের সঙ্গে অতীত মেলেনা। দিনগুলো নিয়ে ভাববার তাঁর অবকাশ কম।
আমার বন্ধুটির নাম অতীন সান্যাল।
অফিসে দিন পনেরোর মত ছুটি ছিল। এই সুযোগে গ্রামের বাড়িতে সস্ত্রীক এসেছে। ওর ছেলে শুভ এখন অস্ট্রেলিয়ায় ডাক্তারি করে। ইভা, ওর স্ত্রী। বলছিল, চলো কদিন নির্জনতায় ঘুরে আসি। শহরের ভিড় আর ভালো লাগেনা।
অতীন আজ সকালে ওর স্যান্ট্রো গাড়ি করে নিজের গ্রামে এসেছে। চারদিকে গাছপালা। মাটির দোতলা বাড়ি। বনমালী কাকা বলে একজন এই বাড়ির দেখাশোনা করে। বহু বছর বাদে অতীন এখানে এসেছে। বনমালী কাকা ঘর দুয়ার পরিষ্কার করেছেন। সাহেব এবং মেমসাহেবের জল খাবারের ব্যবস্থা করেছেন। দুপুরে রান্নার আয়োজনে লেগে পড়েছেন লক্ষ্মী রানী নামে এই গ্রামের একটি মেয়ে।
ওদের বাড়ির কাছেই একটি নদী। ছোটবেলা থেকে এই নদীকে ঘিরে কত কথা, কত ইতিহাস। বিকেল বেলায় অতীন একাই নদী দেখতে বের হোল। ইভা তখন ইজি চেয়ারে শুয়ে বুদ্ধদেব গুহর কোজাগর উপন্যাস পড়ছিল।
হাঁটতে হাঁটতে অতীন নদীর কাছে চলে এলো।ওর কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কবিতার লাইন মনে পড়ছিল, তারপর যেতে যেতে যেতে যেতে এক নদীর সঙ্গে দেখা।
কিন্তু চিরচেনা নদীটা অনেকটা যেন বদলে গেছে। আশপাশে কত নতুন বাড়ি উঠেছে। দূরে খেয়া নৌকা, ওপারে কালী মন্দিরের চূড়া, সেই একই রকম আছে, ওর মনে হলো।
এখন শীতের বিকেল। বিকেল হলেই, মাটিতে দ্রুত সন্ধ্যা নামে।
অতীন অনেকটা হেঁটে একটা বড় কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচে এসে দাঁড়ালো। সঙ্গে সঙ্গে স্মৃতিতে বিদ্যুতের চমক। এই গাছ, এই নদীর ঘাট, সামনের নোঙর করা নৌকো, অবিকল এক রকমই আছে। আর তখনই স্মৃতিতে বিশাল ধাক্কা।
তখন অতীন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। আর, সুনয়না
বিএ ফাইনাল পরীক্ষা দেবে।
একদিন ট্রেনে ওদের আলাপ। তারপর বন্ধুত্ব, তারপর কাছাকাছি আসা।
এই নদীতীর, এই কৃষ্ণচূড়া গাছ, ওদের ভালোবাসার সাক্ষী। অতীন প্রথম দেখার দিনেই বুঝেছিল, তোমায় প্রথম দেখেছিলাম, আমার সর্বনাশ।
সুনয়নার কালো অতল চোখ দুটো দেখে, অতীন প্রথম দিনেই ওকে ভালোবেসে ফেলে। সুনয়না শ্যামাঙ্গী। কিন্তু ওর মাথায় একরাশ কোঁকড়ানো কালো চুল। অতীন সে রাতে ভালো ঘুমোতে পারে নি।
সারারাত জ্বরের ঘোরের মতো ভালোবাসার ঘোরে রাত পার করেছে।
পরদিন সুনয়নার জন্য বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে থেকেছে। পরপর দুটো সিগারেট শেষ করবার পর, সুনয়না বাস থেকে নামলে, সামনে গিয়ে বলেছে,
কথা ছিল, আপনার শোনার মতো একটু সময় হবে?
কি কথা?
ভালো লাগে আপনাকে।
তাই বুঝি!
হ্যাঁতো।
তাহলে সিগারেটটা ছাড়তে হবে।
অতীন হেসে ফেলেছিল।
তারপর কতদিন কত রাত, নদীর জলে কত ঢেউ, কত উথাল পাথাল,
অতীন ভাবে, তখন গাছপালা অনেক সবুজ ছিল, তখন যে কোনো মানুষকেই গল্পের মানুষ মনে হোত।
সংসারে অভাব ছিল দারিদ্র ছিল, কিন্তু কোথাও যেন একটা সুখ ছিল। সরল দিন ছিল। দু চোখে কত স্বপ্ন ছিল।
টিউশনি সেরে সুনয়না নদীতীরে কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচে আসতো। অতীন বলতো, তোমার জন্য এক জীবন অপেক্ষা করতে আমার ভালো লাগে,
সুনয়না হেসে ফেলতো। বলতো, সত্যি সত্যি আমায় ভালোবাসো তুমি?
বাসি তো।
মানে?
তোমার সঙ্গে দেখা না হলে, ভালোবাসার দেশটা আমার দেখা হোত না,
অ্যাই, এটা তো জটিলেশ্বর মুখোপাধ্যায়ের গান,
অতীন গাইতো, তুমি না হাত বাড়িয়ে দিলে,
সুনয়না মুগ্ধ দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে থাকতো।
সন্ধ্যে হোত। আকাশে চাঁদ উঠত। নদীর জলের উপর রাতের জ্যোৎসনা ভেসে যেত। ওরা ভালোবাসার গভীরে ডুবে যেত।
সুনয়না বলতো, বিকেলবেলায় দেখছিলে, পাখিরা ঘরে ফিরছিল,
হুঁ, দেখেছি।
বেশ লাগে না, আমরা কবে ঘরে ফিরবো?
দাঁড়াও, এমএসসি টা কমপ্লিট করি, চাকরি পাই, তারপর,
আমার গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট হলেই, বাড়িতে পাত্র দেখা শুরু হবে,
বুঝেছি,
তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচতে পারব না।
সুনয়না, এই আকাশ, এই নদী, এই কৃষ্ণচূড়া গাছ সাক্ষী, আমি তোমায় ভালোবাসি, যেভাবেই হোক,
একটা কিছু ব্যবস্থা আমি করবোই।
একদিন সুনয়নার পরীক্ষা শেষ হল। অতীন ততদিনে পড়া কমপ্লিট করে, চাকরির দরজায় দরজায় ঘুরে ক্রমশ হতাশ হয়ে পড়ছিল।
কোথাও কোনো আলো নেই, কোথাও কোনো স্বপ্নের পাপড়ি মেলবার জায়গা নেই।
অতীন কৃষ্ণচূড়া গাছটার গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। চোখ ফেটে জল আসছিল। কত কথা, কত ভালোবাসা, কত কান্না, কত নির্ঘুম রাত্রি কাটানো।
অনেকদিন সুনয়নার সঙ্গে দেখা নেই।
একদিন শুনতে পেল, বহরমপুরের পাত্র দীপ্তিমান মুখার্জির সঙ্গে সুনয়নার বিয়ে ঠিক হয়েছে। পুরুষের অক্ষমতা যে কি ভীষণ যন্ত্রণা দায়ক, সেদিন অতীন সেটা বুঝে ছিল। অথচ, সেদিন কিছুই করার ছিল না তাঁর।
অতীন নিজের চোখে বধূ বেশে সুনয়নাকে স্বামীর ঘর করতে যেতে দেখেছিল। মনে-মনে বলেছিল, এত হার, এত পরাজয়, আমি কার কাছে রাখি, কাকে জানাই?
সেই দুঃখে গ্রাম ছেড়েছিল ও।
তারপর ক্রমাগত লড়াই করতে করতে একটার পর একটা সিঁড়ি ভাঙতে ভাঙতে, আজ কর্পোরেট হাউসের বড়কর্তা এখন অতীন।
যে অতীত একদিন ওকে খালি হাতে ফিরিয়ে দিয়েছিল, আজ বর্তমান ওকে তার দশগুণ ফিরিয়ে দিয়েছে। অফিসে সব সময়ে সেলাম পায় আজ কাল ও।
তবুও আজকের বিকেলটা, এই চিরপরিচিত নদী, এই কৃষ্ণচূড়া গাছ, এই নদীতীরের শান বাঁধানো ঘাট, দূর আকাশে থালার মত চাঁদ, তারাদের ঝিকিমিকি, রাতের নদীর শান্ত জলের ঢেউ, সবকিছু মিলিয়ে বুকের মধ্যে কেমন একটা হাহাকার, কেমন একটা অব্যক্ত বেদনা, কেমন সানাইয়ের মীড় মূর্ছনার মতো কারো কান্না যেন অতীনের কানে ভেসে এলো।
মনে হল, কৃষ্ণচূড়া গাছের অদূরে দাঁড়িয়ে সুনয়না কাঁদছে। কিছু যেন একটা বলতে চাইছে অতীনকে। আলো আধো অন্ধকারে দাঁড়িয়ে অতীন সামনের দিকে হাত বাড়ালো।
যখন ওর মনে হলো, সুনয়নার দূরে সরে যাচ্ছে, দূরে সরে যাচ্ছে।
অতীন মনের চোখ দিয়ে যেন দেখতে পেল। সুনয়না বলছে, আমি তো তোমার কাছে আসতে চেয়েছিলাম, অতীন। তুমি তো আমার হাতটা ছেড়ে দিলে,
অতীন মাথা নিচু করে উঠে পড়ল। তারপর হাঁটতে শুরু করল। একসময় ও লক্ষ্য করলো, ওর দু চোখে জল। নিজেকে বোঝালো, কর্পোরেট হাউসের বড় কর্তা সান্যাল সাহেবের চোখে জল মানায় না।
অতীন সান্যাল নিজেকে বলল, আমি সব সময় সামনেটা দেখি, স্মৃতিকাতরতার রোগ আমার নেই।
তবু আজকের বিকেল, নদীতীর, কৃষ্ণচূড়া গাছ, আর ভুলতে না পারা সেই মেয়েটা আজ আমায় স্মৃতিকাতর করে তুললো, সুনয়না, আজ এতো বছর পর তুমি আমাকে কাঁদালে!
তাই বলছিলাম, আমরা ভুলে থাকি, কত অপ্রিয় প্রসঙ্গ আমরা ভুলে যেতে চাই, কিন্তু কখনো কখনো সময় স্থান এবং কাল আমাদের অতীতের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়।
আমার বন্ধু অতীন সান্যালের জীবনে আজ বিকেল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত তেমনি একটা ঘটনা ঘটেছিল।

Please Share This Post in Your Social Media

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More News Of This Category

Categories

© All rights reserved © 2022 mannanpresstv.com
Theme Customized BY WooHostBD