দখল ও দূষণে অস্তিত্ব বিলীনের পথে চলনবিলের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত করতোয়া নদী। নদীটির অধিকাংশ জায়গা দখল করে প্রশাসনের চোখের সামনেই খননযন্ত্রের মাধ্যমে মাটি লুটের মহোৎসবে মেতেছে ভূমিদস্যুরা। এতে ঝুঁকির মুখে রয়েছে সরকারের এলজিইডি বিভাগ কর্তৃক ৪০ কোটি টাকা ব্যয়ে নদীর ওপর নির্মিত দুটি সেতু। এ নিয়ে স্থানীয় জনমনে ক্ষোভ বিরাজ করলেও প্রভাবশালীদের ভয়ে কিছু বলতে পারছেন না এলাকাবাসী।
এ নদীর একটি অবলুপ্ত শাখা সিরাজগঞ্জের তাড়াশ উপজেলার নওগাঁর হাটের দক্ষিণ পাশ দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। আর এখানেই করতোয়া নদী পাবনা ও সিরাজগঞ্জ জেলাকে পৃথক করে চলনবিলে গিয়ে পড়েছে। নদীর ডান তীরে অবস্থিত পাবনা জেলার ভাঙ্গুড়া ও চাটমোহর উপজেলা আর বাম তীরে অবস্থিত সিরাজগঞ্জের তাড়াশ ও উল্লাপাড়া উপজেলা।
সরেজমিনে তাড়াশ উপজেলার নওগাঁ হাটে দেখা যায়, নদীতে বাঁধ দিয়ে রাতদিন পাঁচটি মাটি খনন যন্ত্র (এক্সেভেটর) মেশিন দিয়ে খুঁড়ে মাটি তোলা হচ্ছে ডাম্প ট্রাকে। এ মাটি বিক্রি করেছেন স্থানীয় একটি প্রভাবশালী মহল। খোঁড়াখুঁড়ির কারণে নদীর বুকে যত্রতত্র বড় বড় ডোবার সৃষ্টি হয়েছে। নদী থেকে এমনভাবে মাটিকাটা হচ্ছে যে, এ নদীর ওপর নির্মিত তিনটি উপজেলার আন্তঃসংযোগের দুটি সেতু রয়েছে ঝুঁকির মুখে।
সেতু দুটি ক্ষতিগ্রস্ত হলে ভাঙ্গুড়া থেকে তাড়াশ ও চাটমোহর থেকে তাড়াশ উপজেলার হাজার হাজার মানুষের যোগাযোগ ব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। অথচ চোখের ওপর নদীটির এমন বেহাল দশা দেখে স্থানীয় লোকজন ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখালেও প্রশাসন পালন করছে নীরব ভূমিকা। এ নিয়ে স্থানীয় জনমনে ক্ষোভ বিরাজ করলেও প্রভাবশালীদের ভয়ে তারা কিছু বলতে পারছেন না।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, তাড়াশ উপজেলার নওগাঁ মৌজায় অবস্থিত বাম তীরের জায়গা শতাধিক ব্যবসায়ী পাকা অবকাঠামো তৈরি করে, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন নদীর জায়গা দখল করে। নির্মাণ করেছেন পাকা-আধা পাকা দ্বিতল ভবন। অপর দিকে ভাঙ্গুড়া উপজেলার করতকান্দি মৌজা থেকে কিছু ব্যক্তি মালিকানা দাবি করে ১০ থেকে ১২ জনের একটি সিন্ডিকেট তৈরি করে, নদী থেকে অবৈধভাবে মাটি তুলে বিক্রি করছে। এ সিন্ডিকেটের সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন সুলতানপুর গ্রামের বাসিন্দা মো. রেজাউল করিম ডাব্লু ও সাধারণ সম্পাদক করতকান্দি গ্রামের বিজন দাস লালু। নদী থেকে মাটি কাটার ঠিকাদারি নিয়েছেন স্থানীয় আরেক প্রভাবশালী আব্দুল জব্বার মোল্লা।
স্থানীয় বাসিন্দারা অভিযোগ করছেন নদী রক্ষায় সামাজিক সচেতনতার বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হলেও প্রশাসনের নড়বড়ে ভূমিকায় চলছে লাগামহীন নদী দখল ও দূষণ। দিনের আলোতেই প্রভাবশালীরা বিরামহীন নদী দখলের উৎসব চালালেও নজরে আসছে না সংশ্লিষ্ট দপ্তরের। আর এসব অনিয়ম দৃষ্টিতে আনার পরও দায়সারা সিরাজগঞ্জ ও পাবনা পানি উন্নয়ন বোর্ডের।
তাড়াশ উপজেলার নওগাঁ গ্রামের মো. বাবুল প্রামাণিক, মাহবুর হোসেন, আব্দুল মমিন ও দেলোয়ার হোসেন অভিযোগ করে বলেন, এ যেন মাটি লুটেরাদের অভয়াশ্রম। যেভাবে নদী দখল করা হচ্ছে তা যদি এখনই লাগাম টেনে না ধরা হয়, তাহলে করতোয়া নদী এক সময় যে এখানে ছিল অবস্থা দেখে আর কেউ জানতেও পারবে না। জীবন-জীবিকার রসদ হারাচ্ছে সাধারণ মানুষ। অন্যদিকে ফুলে-ফেঁপে উঠছে দখলকারীরা। এভাবে চলতে দেয়া যায় না। নদী রক্ষায় সবাই কেমন যেন নির্বিকার।
ভাঙ্গুড়া উপজেলার করতকান্দি গ্রামের কলেজ শিক্ষক জাবেদ আলী বলেন, নদী আইনে বলা হয়েছে নদী দখল, অবকাঠামো নির্মাণ, মৎস্য চাষ, নদীর স্বাভাবিক প্রবাহকে বাধাগ্রস্ত করে এমন কর্মকাণ্ড ফৌজদারি অপরাধ বলে গণ্য হবে। অথচ প্রশাসনকে বৃদ্ধি আঙুল দেখিয়ে নদী দখল করা হচ্ছে।
চলনবিল বাঁচাও আন্দোলনের সদস্য সচিব এস এম মিজানুর রহমান বলেন, শুধু করতোয়া নদী নয়, চলনবিলের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত বড়াল, গুমানী নদী নিয়েও আমরা প্রশাসনের সাথে বারবার বসেছি। ফলাফল শূন্য। মানববন্ধন, স্মারকলিপি দিয়েও কাজের কাজ কিছুই হয়নি। যাদের দায়িত্ব এসব রাষ্ট্রীয় সম্পদ রক্ষা করার, তারাই তো কোনো কাজ করে না। ফলে নদী নালা জলাধার দখল এখন নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।
নদী দখল প্রসঙ্গে মো. রেজাউল করিম ডাব্লুর কাছে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, আমাদের ব্যক্তি মালিকানা সম্পত্তি। এ কারণে মাটি কেটে বিক্রি করছি। আর নদী কি ব্যক্তি সম্পত্তি- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আপনি এখানে আসেন। ঠিকাদার জব্বার আপনার সঙ্গে দেখা করবে।
অথচ নদীর জমির খাজনা নেওয়া ও মাটিকাটার বিষয়টি জানা নেই বলে জানান ভাঙ্গুড়া উপজেলার খাঁন মরিচ ইউনিয়নের উপ-সহকারী ভূমি কর্মকর্তা মো. আহসান হাবীব।
তবে ভাঙ্গুড়া উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) তাসমিয়া আক্তার রোজী বলেন, সরেজমিনে গিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
আর তাড়াশ উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. খালেদ হাসান বলেন, নদী সীমানা নির্ধারণ না থাকায় আমরা তেমন কিছু করতে পারছি না। আবার কেউ কেউ ব্যক্তি মালিকানার কাগজপত্রও দেখিয়েছে। এর জন্য প্রয়োজন সমন্বিত উদ্যোগ।
পাবনা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী অমিতাভ চৌধুরীর কাছে করতোয়া নদী দখল প্রসঙ্গে জানতে চাওয়া হলে মোবাইল ফোনে তিনি বলেন, আমরা অনেকগুলো ব্যবস্থা নিয়েছি। কেউ কোনো অভিযোগ দেয়নি। খোঁজ নিয়ে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।