1. admin@mannanpresstv.com : admin :
গল্প -নিখিলেশের জানালায় পঁচিশ বছর পর -সুনির্মল বসু - মান্নান প্রেস টিভি
রবিবার, ১৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ০১:০০ পূর্বাহ্ন

গল্প -নিখিলেশের জানালায় পঁচিশ বছর পর -সুনির্মল বসু

এম.এ.মান্নান.মান্না
  • Update Time : সোমবার, ৪ নভেম্বর, ২০২৪
  • ১৪ Time View
প্রিয় নিখিলেশ,
ভুলে থাকা ভালো। ভুলেই তো ছিলাম। নিজেকে বুঝিয়েছিলাম, যা হবার ছিল, তাই হয়েছে। আমার তো কোন দোষ নেই। ভাগ্যে ছিল না, তাই হয়নি। শুধু শুধু নিজেকে কষ্ট দিয়ে কোন লাভ নেই।
মনে পড়ে, খুব মনে পড়ে। কলেজ জীবন। স্বপ্ন দেখার দিনগুলো। অবশ্য নিখিলেশ, তুমি তখন
এম এ কমপ্লিট করে ডক্টর দীপ্তি ত্রিপাঠীর অধীনে গবেষণায় মেতে আছো।
তোমাদের পাড়ায় ধীরেন গোস্বামীর বাড়ি আমরা ভাড়া এসেছি। আমাদের বাসার পাশেই তোমার প্রাণের বন্ধু অভিযানদের বাড়ি। বিকেলে তোমরা
সাহিত্য নিয়ে আড্ডা দিতে। আমার বাবা বাটা কোম্পানিতে চাকরি করেন তখন, আর আমার মা
বাটা হসপিটালে নার্স।
অভিযানদাই একদিন তোমার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিল। বলল, নিখিলেশ, আমার বন্ধু। সাহিত্যের গবেষক। তারপর আমাকে দেখিয়ে বলল, মনিদীপা সরকার। থার্ড ইয়ার, ইকোনমিক্স অনার্স।
প্রথম আলাপের পর কতদিন তোমাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখে দিন কেটেছে। তখন কাঁঠালি চাপা গাছের নিচে দাঁড়িয়ে জ্যোৎস্নার রাতে কত কথা বলেছি তোমাকে। নিখিলেশ, তুমি কথা বলতে কম, শুনতে অনেক বেশি।
একদিন বিকেলে ঝিলের ধারে দাঁড়িয়ে আমি তোমাকে বললাম, তুমি তো কিছু বলছো না!
কি বলবো?
আমাদের ভালোবাসা, আমাদের ভবিষ্যৎ।
নিখিলেশ, তুমি কেমন অন্যরকম ভাবে আমার দিকে চেয়েছিলে, তারপর বলেছিলে, এত তাড়া কিসের?
বাহ, ব্যস্ত হবো না?
বাড়ি থেকে অন্য জায়গায় যদি বাবা-মা বিয়ে ঠিক করে ফেলেন, তখন?
ভালো তো! বরের সঙ্গে সংসার করতে চলে যাবে।
নিখিলেশ, তোমার কোন মন নেই। তুমি বড্ড নিষ্ঠুর।
কথা শুনে তুমি হেসেছিল। বলেছিলে, সময়ের উপর সবটা ছেড়ে দাও।
আমি মেনে নিতে পারিনি। ভিতরে ভিতরে আমি খুব ব্যস্ত হয়ে পড়ছিলাম। সত্যি কথা বলতে কি, আমি তোমাকে একতরফা প্রায় ভালবেসে ফেলেছিলাম।
রাত জেগে তুমি যখন গবেষণার কাজ করতে, কত রাত পর্যন্ত আমি আমাদের বারান্দায় দাঁড়িয়ে তোমার দিকে চেয়ে থাকতাম। তুমি ঘুমোতে না গেলে, আমার চোখে ঘুম আসতো না।
তোমার মনে আছে নিখিলেশ, একদিন তোমার সঙ্গে বসুশ্রী হলে উত্তম কুমার অঞ্জনা ভৌমিকের কখনো মেঘ ছবি দেখতে গিয়েছিলাম।
নিখিলেশ, তখন তুমি দারুন দেখতে ছিলে, পায়জামা পাঞ্জাবিতে তোমাকে দারুন দেখাতো। আমার বন্ধু জিনিয়া বলেছিল, তোর মনের মানুষটা
কিন্তু দারুণ দেখতে!
আমি সেটা জানতাম। কিন্তু কখনো মুখে সে কথা কাউকে বলিনি। আমার মধ্যে একটা চাপা স্বভাব আছে। তাই নিজের অনুভূতিগুলো ভালোলাগা মন্দলাগা কোনটাই মুখ ফুটে অন্যকে বলতে ইচ্ছে হয়নি আমার। তবে মনে মনে তোমাকে নিয়ে আমার একটা চাপা অহংকার ছিল।
এক শীতের সন্ধ্যায় সার্ভিস মার্কেটে তোমার সঙ্গে দেখা হলো। বললাম, কিছু কি ভাবলে?
কই, না তো!
কি হবে আমাদের ভালোবাসার?
একটু সময় চাই। আমার গবেষণা প্রায় শেষ পর্বে। তারপর জানাবো। আমার জন্য একটু অপেক্ষা করতে পারবে না?
পারবো। আমি বলেছিলাম।
কিন্তু আলিপুরদুয়ারের এক পাত্রপক্ষের সঙ্গে বাড়ির কথাবার্তা ফাইনাল হয়ে গেছিল। ওরা আমাকে পছন্দ করেছিলেন। বিয়ে ঠিক হয়ে গেল আমার।
তোমার সঙ্গে যোগাযোগ করবার অনেক চেষ্টা করেও, পারলাম না। তার উপর আমাদের ভালোবাসার ব্যাপারে তোমার উদাসীনতা আমাকে খুব যন্ত্রণা দিচ্ছিল। আমি মা বাবার কথায় রাজি হয়ে গেলাম।
বিয়ের আগে গড়িয়াহাট মোড়ে যেদিন তোমার সঙ্গে দেখা হলো, সেদিন তোমাকে সব কথা বললাম।
নিখিলেশ কথাটা জানার পর, তোমার মুখটা কালো হয়ে গেল। তুমি যেন বিশ্বাসই করতে পারছিলে না যে, আমার অন্যত্র বিয়ে হয়ে যাবে। যদি ভুল না দেখে থাকি, আমি তোমার চোখের কোনায় সেদিন
জল দেখেছিলাম।
নিখিলেশ, তোমার বিরুদ্ধে আমার অনেক অভিযোগ আছে। তুমি অন্য অনেকের মতো নও। নিজের জন্য কিছু চাইতে পারো না। নাকি, চাইতে জানো না। কত সহজেই অন্যকে বিশ্বাস করো।
আমি ডাকে তোমাকে বিয়ের নেমন্তন্নের কার্ড পাঠিয়েছিলাম। তুমি আসো নি। তবে কুরিয়ার করে আমাদের জন্য উপহার পাঠিয়ে দিয়েছিলে।
নিখিলেশ, আমার স্বামী সু মৌলেন্দ্র আলিপুরদুয়ারের নামকরা শিল্পপতি। অনেকগুলো কারখানা তাঁর। আমার মেয়ে কোয়েনা দার্জিলিং কনভেন্টে পড়ে। সবই ভালো। কিন্তু আমাকে দেবার মত সময় আমার স্বামীর নেই। আমি বড় একা।
সময় কাটাবার জন্য বরাবরই বই পড়ার অভ্যাস ছিল। কবি অমৃত জ্যোতির কবিতা আমি নিয়মিত পড়ি। কদিন আগে এখানকার সার্কিট হাউসে একটা কবিতার আসরে কবি অমৃত জ্যোতি এসেছিলেন।
তাঁকে একবার চোখের দেখা দেখবো বলে আমি সু
মৌলিন্দ্রকে অনুরোধ করেছিলাম।
ও আমাকে সার্কিট হাউসে নিয়ে গেল। কবি অমৃত
জ্যোতি যে তোমার ছদ্মনাম, সেটা জানা ছিল না।
মাইকে যখন তোমার নাম ঘোষিত হল, তুমি মঞ্চে এলে, তখন আমার বুকের ভেতরটায় সাত সাগরের ঢেউ। গোটা শরীর আমার তখন কাঁপছে। দেখলাম,
তোমাকে পঁচিশ বছর বাদে দেখলাম।
ধুতি পাঞ্জাবিতে একেবারে মঞ্চের রাজকুমার। না, এটা বোধ হয় বাড়াবাড়ি বলে ফেললাম। তোমার সামনের দিকের চুলে পাক ধরেছে। জুলপি সাদা। বাকি মনে হলো, একই আছো তুমি, নিখিলেশ!
আমার তোমাকে খুব ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছে করছিল।সু মৌলিন্দ্র আমাকে একবার বলেছিল, চলো, কবি ভদ্রলোকের সঙ্গে একবার দেখা করে আসি! আমি বলেছিলাম, না, কি দরকার?
অথচ, নিখিলেশ, পঁচিশ বছর পর তোমার সঙ্গে দেখা হলে, আমি কথা না বলে কি করে পারি বলো?
আমি সময়কে দোষ দিচ্ছি, আমি ভাগ্যকে দোষ দিচ্ছি। এছাড়া, আমি আর কি বলতে পারি? যদি তোমার সঙ্গে আবার কথা বলতে পারতাম, তাহলে জানতে চাইতাম, তুমি কি মানুষ, নিজেকে জ্বালিয়ে
কবিতায় ধূপের সুগন্ধ ছড়িয়ে দিয়েছো। এত অভিমান কেন? কার উপর এত অভিমান? কেন অভিমান?
আমার লেডিস ক্লাবের বান্ধবী মানসী সেন বলছিলেন, কবি অমৃত জ্যোতি অবিবাহিত।
আমি বলেছিলাম, তাই বুঝি!
মানসী হেসে বলেছিলেন, কে যেন যৌবন বয়সে হৃদয়ে দাগা দিয়ে গেছে।
এ কথা শুনে আমার বুকের মধ্যে কান্নার ঢেউ উঠেছিল। পঁচিশ বছর আগেকার কত কত স্মৃতি, কত দিন রাত্রির স্মৃতি কথা মনে পড়ছিল।
নিখিলেশ, যদি তোমাকে প্রশ্ন করতে পারতাম, আগের মত, তাহলে জানতে চাইতাম, তোমার কবিতায় এত কান্না কেন? কেন কাঁদাও? অন্যকে কাঁদিয়ে তোমার কি লাভ? এত গভীর যার ভালবাসার মন, সেই লোকটা অতীতে একদিন ভালোবাসার কথা মুখ ফুটে বলতে পারেনি।
নিখিলেশ, দেশ জুড়ে তোমার অনেক মুগ্ধ পাঠক।
আমি না হয়, তোমার নিন্দুক পাঠিকাই রয়ে গেলাম।
সেই তুমি পঁচিশ বছর বাদে আমার সামনে এলে, কবি অমৃত জ্যোতির আড়াল সরিয়ে।
এখন বুঝতে পারছি, সেদিন তোমার ভালোবাসার মধ্যে যে গভীরতা ছিল, আমি সেটা বুঝে উঠতে পারিনি। আমার বিয়ের খবর তোমাকে সেদিন কতটা কষ্ট দিয়েছিল, পঁচিশ বছর বাদে এখন বুঝতে পারছি।
প্রত্যেকটা ব্যথার ফুল তোমার কবিতার ছন্দে ফুটে উঠছে। ভুলগুলোকে ফুল হিসেবে ফুটিয়ে তোলা একজন দক্ষ কবির কাজ।
তুমি সেটা পেরেছো।
নিখিলেশ, আমি বিবাহিতা নারী। আমার তো কোথাও কোনো অভাব নেই। ভালোবাসা ছাড়া। এ আমার কি হলো, আমি তোমাকে ভুলে থাকতে পারছি না।
তোমার জন্য তো লেখার জগত পড়ে রয়েছে। আমার জন্য চোখের জলের জগৎ। স্মৃতি বিস্মৃতির আল পথে এবার আমি একলা হেঁটে যাবো।
বিখ্যাত কবি অমৃত জ্যোতি একদিন প্রাণের গভীর থেকে আমাকে ভালোবেসেছিলেন, একজন নারীর কাছে এর চেয়ে বেশি আর কতই বা প্রত্যাশা থাকতে পারে?
ভালো থেকো, নিখিলেশ।
ইতি,
অনেক কাল আগের কোনো পরিচিতা।

Please Share This Post in Your Social Media

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More News Of This Category

Categories

© All rights reserved © 2022 mannanpresstv.com
Theme Customized BY WooHostBD