কিংশুকের বিয়ের সময় নেমন্তন্ন করা সত্ত্বেও, সুলগ্না আসতে পারে নি। ও তখন ব্যাঙ্গালোরে ছিল। ওর হাজবেন্ড নীতিশ অফিস থেকে ছুটি ম্যানেজ করতে পারে নি।
গতকাল কিংশুকের অফিসে দুপুরের দিকে একটা ফোন এলো।
তুমি কি এখন অফিসে?
হ্যাঁ।
তোমার বিয়েতে থাকতে পারিনি। আগামীকাল ফ্লাইটে কলকাতা যাচ্ছি। তোমার বাড়ি উঠবো।
কিংশুক বলে, তাই নাকি! ভালো কথা। এসো।
মধুরিমাকে তোমার কথা বলেছি। ওর সঙ্গে আলাপ হবে।
নীতিশ সঙ্গে থাকবে।
বাহ। চলে এসো।
ফোন কেটে যায়।
কিংশুক দূর অতীতচারী হয়ে পড়ে। পেছনে হাঁটতে হাঁটতে সাদা কাশফুলে ভরা সবুজ মাঠে ছুটে বেড়াবার দিনগুলো মনে পড়ে। ধানক্ষেতের আল পথ ধরে ছাপা শাড়ি পরে মাথার দুদিকে রিবন দিয়ে
চুল বেঁধে ছুটে আসতো সুলগ্না। মাঝে মাঝে কাশবনে লুকিয়ে পড়তো। বলতো, তুমি আমায় ছুঁতে পারলে না!
তখন আকাশ ঘন নীল। নদীতে ভাসমান নৌকো। শিউলি ফুলের গন্ধ বাতাসে। কাঁচা মিঠেল রোদ্দুর।
কিংশুক সুলগ্নাকে কাশ বনে খুঁজে খুঁজে দিশেহারা।
কত কত দিন নদীর পাড়ে দুজনে হাতে হাত ধরে কতদূর চলে যাওয়া। ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যে। আকাশে চাঁদ। আকাশে তারা। পথে পড়ে থাকা শিমুল ফুল।
কিংশুক ভাবলো, সে একটা জীবন ছিল বটে!
ওদের এই মেলামেশা পাড়ার অনেকেই ভালো চোখে দেখেননি।
বৈশাখের দুপুরে কাঁচা আম মাখা করে আনতো সুলগ্না। বলতো, খেয়ে নাও, তোমার জন্য অনেক কষ্ট করে বানিয়েছি।
কিংশুক মুখে দিয়ে বলতো, কি ঝাল! আমার মুখ জ্বলে যাচ্ছে।
এইটুকু ঝাল খেতে পারো না। তুমি কি করে বড় হবে?
আমার বড় হবার দরকার নেই।
হ্যাঁ, দরকার আছে। বড় হয়ে চাকরি-বাকরি জুটিয়ে আমাকে তোমার কাছে বিয়ে করে নিয়ে যাবে না তুমি?
কিংশুক মাথায় নিচু করে শুনতো। তারপর বলতো,
আমাকে এতটা ভালোবাসো তুমি?
তুমি বোঝো না?
ইঞ্জিনিয়ারিং কমপ্লিট করতে আমার আরো তিন বছর সময় লাগবে।
আমি অপেক্ষা করবো।
বেয়ারা টেবিলে চা রেখে গেল। কিংশুক চায়ে মুখ ডুবিয়ে ভাবলো, বাড়ি ফিরে মধুরিমাকে ওদের বাড়িতে আসার কথা জানাবে। রাতে বাড়ি ফিরে ও মধুরিমাকে সুলগ্নাদের আসবার কথা জানালো।
মধুরিমা বলল, আজ তুমি অফিস ছুটি নাও। ওদের সঙ্গে আমার পরিচয় নেই। তুমি বাড়ি থাকলে, ভালো হয়।
দুপুরের দিকে একটা উবের ট্যাক্সি করে ওরা এলো।
সুলগ্না আর নীতিশ ঘরে ঢুকলো।
নীতিশ বলল, ওর কাছে আপনার অনেক গল্প শুনেছি। আপনারা ছোটবেলাকার বন্ধু।
কিংশুক মনে মনে ভাবে, সুলগ্না কি শুধুই ওর ছোটবেলাকার বন্ধু। নাকি, তার চেয়ে আরো বেশি কিছু?
কিংশুক বলে, ছোটবেলায় পাশাপাশি বাড়িতে থাকতাম।
নীতিশ বলল, আপনার অন্য একটা গুণের কথাও আমি জানি।
কিংশুক বিস্মিত ভাবে ওর দিকে তাকালো।
নীতিশ বলল, আপনি ওয়েস্ট বেঙ্গলের রিনাউন্ড রাইটার।
কিংশুক করুণভাবে হাসে। বলে, যে কথাগুলো মুখে কাউকে বলতে পারি না, সেগুলোই লিখি।
সুলগ্না বলল, বাহ, দুজনে এমন গল্প জমিয়ে দিয়েছো, যেন এখন আমাকে চিনতেই পারো না!
মধুরিমা বলল, ওর কাছে তোমার কথা অনেক শুনেছি।
সুলগ্না জিজ্ঞাসা করল ,কি রকম?
বর্ষার দিনে গাব গাছের জঙ্গলে ডোবার পাশে সোনা ব্যাঙ ধরতে যাওয়ার কথা।
আর?
কাঁঠালি চাপা গাছের নিচে বসে তেঁতুলের আচার খাওয়া।
সুলগ্না বলল, তোমার বরটার আমাকে ছাড়া চলতো না যে!
মধুরিমা এ কথা শুনে সামান্য হাসলো।
দুপুরে খাওয়া দাওয়ার পর নীতিশ বালিগঞ্জে ওরা কাকার সঙ্গে দেখা করতে গেল।
মধুরিমা রান্নাঘরে বাসনপত্র গোছাচ্ছিল।
সুলগ্না তখন কিংশুকের কাছে এলো।
কেমন আছো তুমি?
ভালো।
আমাকে দোষ দিও না, পাড়াতে জানাজানি হওয়াতে সাততাড়াতাড়ি বাড়ি থেকে আমার বিয়ে দেওয়া হলো।
সুলগ্না, আমি কাউকে দোষ দিইনি। আমি তো কিছু হারাইনি। এই কথাটা বলবার জন্য আমি লিখি।
আমাকে কষ্ট দিও না, কিংশুক। আজ আমার সব আছে। শুধু আমাকে দেবার মতো নীতিশের হাতে
সময় বেশি নেই।
মানে?
মানে, আজ এই পার্টি, কাল ওই পার্টি। আগে আগে আমি যেতে চাইতাম না। আজকাল যাই। ভুলে থাকতে চাই, সেদিনের অতীতকে।
কিংশুক বলল, তখন আমার পায়ের নিচে কোন জমি ছিল না। তোমার মা-বাবা ঠিকই করেছিলেন।
সুলগ্না বলল, তোমার লেখা সব আমি পড়ি। পড়তে পড়তে সেই দিনগুলোর মধ্যে দিয়ে হেঁটে যাই।
আমার লেখা তুমি পড়ো?
সব। সব।
কিংশুক বলল, সময়টাকে আমি লেখায় ধরে রাখছি। পদ্ম পাতার দিন, শালিক ওড়া সকাল, বিলের ধার, দুর্গাপুজোর সময় অনিল পালের ঠাকুর দেখতে যাওয়া, খালপাড়ে বড়শি দিয়ে পুঁটি মাছ ধরা, সব থাকে। আমার লেখায় সব থাকে। আমি লেখায় এর কিছুটি বাদ দিতে পারি না।
সুলগ্না বলল, আমি আল পেরিয়ে তোমার কাছে আসতাম। তোমার লেখায় দেখি, রেললাইন পেরিয়ে সাদা শাড়ি পরে অনুরাধা আসছে। আমি তো ছাপা শাড়ি পরতাম।
কিংশুক হেসে বলে, অনুরাধা তোমার ছায়া, তুমি নও।
সুলগ্না মন খারাপ করে বলে, তুমি আমাকে এভাবে আঘাত করতে পারলে?
আমি কখনো কাউকে আঘাত করিনি। বরং, অন্যের কাছ থেকে পাওয়া আঘাত বারবার সহ্য করে গেছি।
সেটাই আমার লেখার প্রেরণা।
মধুরিমা ঘরে এলো।
বলল, ছোটবেলার গল্প হচ্ছে বুঝি?
সুলগ্না বলল, তোমার বরের সঙ্গে কথা বলে শান্তি নেই। ও বলে কম, শোনে বেশি।
মধুরিমা বলল, তুমি কখনো ছোটবেলায় ওকে শাসন করো নি।
সুলগ্না হেসে বলল, দুঃশাসনকে কেউ শাসন করতে পারে? আমি পারিনি। এবার তুমি চেষ্টা করে দ্যাখো!
সন্ধ্যাবেলায় নীতিশ ফিরে এলো।
মধুরিমা ওকে লুচি তরকারি এবং কফি খেতে দিল।
নীতিশ বলল, কিংশুকবাবু! এতদিন শহরে আছে, অথচ ওর মধ্যে গ্রাম্য ভাবটা যায়নি।
কিংশুক কোনো উত্তর দিল না।
নীতিশ আবার বলল, প্রফেশনে সাইন করতে গেলে, ওয়াইফের একটা ভূমিকা থাকা চাইতো? ওর মধ্যে সেটার খুব অভাব।
মধুরিমা বলে, একটু সময় দিলে সব ঠিক হয়ে যাবে।
নীতিশের ফোন বেজে ওঠে। পবন মিত্তালের ফোন।
ইয়েস স্যার! বলুন!
এখন কোথায়?
ক্যালকাটা।
কাল দশটায় অফিসে আসুন!
কি ব্যাপার?
একটা টেন্ডার কল আছে।
ঠিক আছে। রাতের ফ্লাইট ধরছি।
রাতের ফ্লাইটে নেতাজি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে ওরা বাড়ির দিকে উড়ে যায়।
রাতে মধুরিমা কিংশুককে বলে, তোমার ওই বান্ধবীটার সঙ্গে ওর হাজবেন্ডের কোন মিল নেই, বুঝলে?
কিংশুক চুপ করে থাকে।
মনে মনে ভাবে, যার সঙ্গে ওর মনের মিল ছিল, সেই যখন জীবন থেকে হারিয়ে গেল, তখন থেকে জীবনের আলো নিভে গেছে ওর। সবাই তো রাতারাতি নিজেকে পাল্টাতে পারে না। এটা সুলগ্নার দোষ নয়। ভাগ্যের দোষ!
মধুরিমা রেডিওতে রবীন্দ্র সংগীত চালিয়ে দিল। ওখানে গান বাজছিল,
আমার এ পথ তোমার পথের থেকে
অনেক দূরে!
কিংশুক ভাবছিল, জীবনের শুরুতে যেমন ভাবে জীবনটা শুরু করব ভেবেছিলাম, তেমনটা হল না।
কাশফুলের বনে লুকোচুরি খেলা, মাঠে মাঠে গাংচিল ওড়া, কাঁঠালি চাপার বনের সুগন্ধ আজও নাকে লেগে আছে।
এটুকুই সঞ্চয়। যা পাবার নয়,
জীবনভর খুঁজে গেলেও, তার দেখা মেলে না।
শুধু তার স্নিগ্ধ সুবাস টুকু সারা জীবন চলার পথে আলোর রোশনি ছড়িয়ে যায়।