1. admin@mannanpresstv.com : admin :
গল্প -দূরভাষিনী -সুনির্মল বসু - মান্নান প্রেস টিভি
রবিবার, ১৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:৪২ পূর্বাহ্ন

গল্প -দূরভাষিনী -সুনির্মল বসু

এম.এ.মান্নান.মান্না
  • Update Time : বুধবার, ৬ নভেম্বর, ২০২৪
  • ১৭ Time View
আলাস্কা,হোয়াট ইজ দ্য টাইম নাউ?
আমি তখন ফোনে কান পেতে উৎকর্ণ হয়ে আছি। একটু বাদেই আমেরিকার মিশিগান শহর থেকে কথা ভেসে এলো, ভারতবর্ষের কলকাতায়,
আমার কাছে, আমার শহরে।
আলাস্কা জানালো, এখন ভোর পাঁচটা ছাব্বিশ। আমি ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি, আমাদের এখানে
বিকেল চারটে।
ভদ্র মহিলার সঙ্গে আলাপ হয়েছিল, লেখার সূত্রে।
আমি তখন বাংলাদেশের ঢাকা শহর থেকে প্রকাশিত একটি পত্রিকায় কবিতা লিখতাম।
ভদ্রমহিলার আদি বাড়ি কুমিল্লা শহরে।
তিনি আমার লেখা নিয়মিত পড়তেন এবং এখনো পড়েন। একদিন এভাবেই প্রথম আলাপ হয়েছিল তাঁর সঙ্গে।
তাঁর কাছ থেকে জেনেছিলাম, অল্প বয়সে স্বামীকে হারিয়ে কত কষ্ট করে তিনি সন্তানদের মানুষ করেছেন, বড় করেছেন, প্রতিষ্ঠিত করেছেন।
এই মাকে আমি বড় শ্রদ্ধা করি।
তিনি প্রকৃতিকে ভালোবাসেন। তিনি রান্না করতে ভালোবাসেন। এক সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অডিটরিয়ামে নৃত্য পরিবেশন করে যথেষ্ট সুনাম কুড়িয়েছিলেন। একসময় তার সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড বহুদূর প্রসারিত হয়েছিল।
সেই দূরভাষিনীর ফোন আসতো, সাধারণত দুপুর বেলার দিকে। অনেকক্ষণ কথা হোত।
আমাকে প্রশ্ন করতেন,
আপনার বাড়ির কাছে নদী আছে?
হ্যাঁ।
আপনি নদী দেখতে যান?
মাঝে মাঝে।
আজকে বাজারে গেছিলেন?
হ্যাঁ।
কি মাছ কিনলেন?
একটা রুই মাছ আর কিছু মাঝারি সাইজের চিংড়ি।
আমি বাজার করতে ভালোবাসি। এখানে চালানি মাছ পাওয়া যায়।
আপনি নিজে রান্না করেন?
রান্না করতে আমার ভালো লাগে। তবে তবে ঢাকা বা কলকাতার মতো জিনিসপত্র এখানে সব সময় পাওয়া যায় না।
তাই নাকি?
এখানে সামুদ্রিক মাছ বাজারে খুব চলে। একদিন বড় সাইজের দুটো ইলিশ মাছ এনেছিলাম। বাড়ির সবাই খুব ভালো খেয়েছে।
আমি গল্প খুঁজি।
আমি প্রশ্ন করি,
আপনাদের বাড়ির পাশটা কেমন?
শীত এসে গেছে। বরফ পড়লে, রাস্তাঘাট প্রায় বন্ধ হয়ে আসে। গাড়ি চালাতে খুব অসুবিধা হয়। জানেন, সেদিন গাড়ি চালিয়ে একটু দূরে চলে গিয়েছিলাম, ফেরবার পথে একটা লেকের ধারে
লম্বা ঠোঁট ওয়ালা বড় বড় সাদা পাখিদের পাড়ে বসে থাকতে দেখলাম। কী পাখি, নাম জানিনা।
এইসব পাখি বাংলাদেশে দেখিনি।
মাঝে মাঝে তিনি তাঁর স্বদেশের স্মৃতিতে ফিরে যেতেন।
কী সুন্দর করে বলতেন, পদ্মা নদীর কথা।
বর্ষায়, গ্রীষ্মে, শীতে, বসন্তে কিভাবে যে নদী চেহারা বদলে ফেলে, তাঁর মুখে সে কথা শুনতে শুনতে আমি কল্পনায় বহুদূরে চলে যেতাম।
আপনি কত দেশ ঘুরেছেন!কত আপনার অভিজ্ঞতা।
ও, আপনাকে তো বলা হয়নি। এখানে একটা প্রাচীন দুর্গ প্রাকারের মতো বিশাল প্রাসাদ রয়েছে। ওখানে কেউ থাকে না। আমি প্রথম দিন গাড়ি ড্রাইভ করে আসবার সময় গাড়ি থামিয়ে নেমে পড়লাম।
তারপর?
মাঠের পাশে গাড়িটাকে দাঁড় করিয়ে কিছুটা সামনে এগিয়ে গেলাম।
কী দেখলেন?
প্রাসাদের গায়ে অজস্র গাছপালায় ঢেকে আছে।
বাড়িটার মধ্যে ইতিহাসের গন্ধ পেলেন?
তা যা বলেছেন। ইতিহাস তো আছেই। সেটা কি, তা জানি না।
আমি মনে মনে ভাবছিলাম, একদিন হয়তো এই প্রাসাদে ঘোড়া ছুটিয়ে রাজপুরুষেরা আসতেন।
আপনি চুপ করে গেলেন কেন? কোন কি লেখার বিষয় পেলেন?
না, তবে জেনে ভালো লাগছে। সেদিন যেটা বাস্তব ছিল, আজ তাই ইতিহাস। আর, আজকের দিনগুলো একদিন ইতিহাস হয়ে যাবে।
আপনি প্রতিদিন লাইব্রেরী যান?
হ্যাঁ। বইয়ের মধ্যে পড়তে পড়তে অনেক সুন্দর ভাবে সময়টা কেটে যায়। জানেন, আমার বান্ধবীর লেখা চিঠিগুলো যত্ন করে পড়ি। কী সুন্দর সময় কেটে যায়। সেদিন এক বান্ধবী আমার স্কুল জীবনের সাদাকালো ছোটবেলাকার ছবি পাঠিয়েছিল। আমি তো নিজেকে তখন ছবিতে চিনতেই পারি না।
ও, তাই নাকি?
হ্যাঁ।
আমাদের প্রত্যেকের বুকের মধ্যে একটা ছেলেবেলা লুকিয়ে থাকে। তাকে কখনো ভোলা যায় না।
ঠিক বলেছেন। আজ সকালে গাড়ি নিয়ে বেরিয়েছিলাম। পথে একটা ঝিল দেখতে পেলাম।
গাড়ি থামালাম। এখানে এখন প্রচন্ড ঠান্ডা। সকালের রোদ্দুর এসে পড়েছে ঝিলের জলে।
পাড়ে উঠে অনেকগুলো কচ্ছপ রোদ্দুর পোহাচ্ছে।
দেখে খুব ভালো লাগলো। তাই আপনাকে জানালাম।
আপনার কাছ থেকে এইসব উপকরণ পাই। আমার লেখার সুবিধা হয়। আপনার চোখ দিয়ে আমি আপনার দেশটাকে যেন দেখতে পাই।
আমিও আপনার কথা শুনে কলকাতা ভারত বর্ষ সম্পর্কে একটা ধারণা পাই।
আপনি মনে হয় এখন ব্যস্ত আছেন? এখন ফোন ছাড়ি?
উনি বললেন, হ্যাঁ,একটু পরে আমাকে গাড়ি নিয়ে বাইরে বের হতে হবে।
চারদিকে ভোরের কুয়াশা। আকাশটা মেঘলা।
বৃষ্টি হবে কিনা, বুঝতে পারছি না। দাঁড়ান,
আমি আলাস্কাকে জিজ্ঞেস করি,
আলাস্কা, হোয়াট ইজ দ্য ওয়েদার রিপোর্ট অফ টুডে?
দেয়ার উইল বি হেভি রেইন ফল টুডে। ইউ শুড টেক ইয়োর আমব্রেলা।
আমি কলকাতায় থাকি। ভাবতে বসি, কোথায় এগিয়ে গেছে পৃথিবী!
দূরভাষিনী একদিন ফোন করলেন। বললেন, আমার বাবা ছিলেন হাওড়ার শিবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক। আমার পড়াশোনা ঢাকায়। পাশাপাশি নাচ গান সংস্কৃতি চর্চার মধ্যে সব সময় জড়িয়ে ছিলাম। ঢাকা ইউনিভার্সিটি পড়বার সময় বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে জড়িয়ে ছিলাম।
তারপর বিয়ে হল। আমার দুই ছেলে দুই মেয়ে।হাসবেন্ড মারা গেলেন। দুই ছেলে, দুই মেয়েকে অনেক কষ্ট করে মানুষ করলাম। দুই মেয়ের বড় ঘরে বিয়ে হয়েছে। ওরা খুশিতে আছে। বড় ছেলে ডাক্তার, ছোট ছেলে কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার। দুজনেই বিবাহিত। জীবন স্বাভাবিক ছন্দে এগিয়ে চলল।
ও আচ্ছা।
জানেন, আমি একদিন কবরস্থান দেখতে গিয়েছিলাম।
কেন?
বয়স হয়েছে তো!
ওসব নিয়ে এখন ভাবার দরকার নেই।
কিন্তু জীবনের সত্যিটাকে তো মানবেন।
তা অবশ্য।
আজ সকাল থেকে সেই দূরভাষিনীর কথাই ভাবছি।
কী মায়াময় তাঁর কণ্ঠস্বর। সংসারের জন্য কত তাঁর আত্মত্যাগ।
কলকাতায় বসে আমি ভাবি, আমেরিকার মিশিগান শহরে এখন তুষারপাত ঘটছে। লম্বা সিডান গাড়ি চালিয়ে তিনি পথ চলতি লেকের পাশে দাঁড়িয়ে পরিযায়ী পাখি দেখছেন। গায়ে লম্বা কোট, মাথায় সুন্দর টুপি।
তিনি বরফের উপর হেঁটে চলেছেন।
অথবা, হাজার বছরের পুরনো রাজপ্রাসাদের পাশে দাঁড়িয়ে জঙ্গলে ঢাকা প্রাসাদের জরাজীর্ণ দৃশ্যপটের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি ইতিহাস দেখছেন, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখছেন শহরের।
আবার কখনো নিজের বাড়ির আপেল বাগানে হেঁটে বেড়াচ্ছেন। কিংবা, নাতনিকে সঙ্গে করে নিজের হাতে বসানো লঙ্কা গাছ থেকে লঙ্কা তুলে আনছেন, রান্নার প্রয়োজনে। অবশ্য জানিয়ে রাখি, আমরা লঙ্কা বলি বটে, তিনি বলেন, মরিচ।
কলকাতার ঘরকুনো ডাল ভাত খাওয়া বাঙালী আমি। জীবনে যার সঙ্গে কখনো মুখোমুখি কথা হবে না, তাঁর এই অসম্ভব আন্তরিক ব্যবহার আমার মনের ঘরে চিরদিনের জন্য থেকে যাবে।
একদিন এই পৃথিবীতে আমরা কেউ থাকবো না।
অথচ, সাহিত্যের সূত্রে এই প্রীতির বন্ধন থেকে যাবে। হাজার হাজার মাইলের ব্যবধান সেখানে কোন বাধাই নয়।
দুটি ভিন্ন দেশে বসে আমরা সাহিত্যের মধ্যে দিয়ে দেশ কালের সীমানা ছাড়িয়ে
নিজেকে বিশ্বভুবনে ছড়িয়ে দিতে পারবো।
সেটাই হয়তো ঈশ্বরের ইচ্ছে।

Please Share This Post in Your Social Media

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More News Of This Category

Categories

© All rights reserved © 2022 mannanpresstv.com
Theme Customized BY WooHostBD