চারদিকে ধূধূ বালিয়াড়ি। মাঝে ছোট্ট শান্ত নদী। সরস্বতী নদী এখানে এসে প্রায় ছোট বিলে পরিণত হয়েছে। সামনে চর। মোহনপুরের চর।
ওসমান মিঞা হাট থেকে ফিরছিলেন। নদীর ওপর ডিঙ্গি নৌকায় বসে বাউল ঠাকুর এক তারা বাজিয়ে গান গাইছিলেন, কোথায় যাও রে মাঝি, আমার ভাঙ্গা নাও।
ওসমান হাঁক দিল,ক্যামনে আছেন, বাউল ঠাকুর? গান থামিয়ে তিনি জবাব দেন,
ঈশ্বর যেইভাবে রাখছেন।
যান কই?
মল্লিক বাড়ি। সেইখানে আমার অন্নপূর্ণা মা আছেন,
তাঁর সঙ্গে দেখা করতে।
হ। মল্লিক বাবুর মাইয়াটা বড্ড ভালো মনের,
আমি শুনছি।
অভাবের দিন। যেদিন খাবার পাই না, ওই বাড়ি যাই। অন্নপূর্ণার ভান্ডার আমার জন্য খোলা থাকে।
সে আমারে বসাইয়া খাওয়ায়।
বাউল ঠাকুর গান ধরলেন, খাঁচার ভিতর অচিন পাখি ক্যামনে আসে যায়, জানতে পারলে মন বেড়ি দিতেম তাহার পায়।
ওসমান মিঞা হাঁটা শুরু করল।
বলল, চলি বাউল ঠাকুর! আমারে অনেক পথ যাইতে হইবো।
দুপুর দুটো নাগাদ বাউল ঠাকুর মল্লিক বাড়ির মূল ফটকের কাছে এসে দাঁড়ালো। ওপরে পাথরের গণেশ মূর্তি।
তাঁর এক তারার সুর বেজে উঠতেই,
ভেতর থেকে তাঁতের শাড়ি পরা নীলাঞ্জনা ছুটে বাইরে বেরিয়ে এলো।
বাইরে দাঁড়িয়ে কেন? ভেতরে এসো বাউল দাদু! তুমি ভীষণ ঘামিয়ে গিয়েছো। কত দূর থেকে আসছো বলো তো?
মানিকপুরের ঘাট থেকে আসছি।
হাত মুখ ধোও, ঘরে এসে বোসো। আমি তোমার জন্য রান্না করে রেখেছি।
জানি তো। মা আমার সাক্ষাৎ অন্নপূর্ণা। তোর অনেক ভালো হবে মা।
নীলাঞ্জনা বলল, কত ছোটবেলায় মাকে হারিয়েছি।
পড়াশুনো বেশি দূর করতে পারিনি। আমার আর কি ভালো হবে দাদু?
ওরে, ঈশ্বর মানুষের মন দ্যাখেন। তুই তো সেখানে রাজরাজেশ্বরী। কত বড় মন তোর!
বাউল দাদু, তুমি খাওয়া-দাওয়া পরে আমাকে কিন্তু গান শোনাবে।
শোনাবো রে পাগলি, শোনাবো। কি গান শুনবি বল?
মহুয়ার গান।
বেশ, তাই হবে। বাবা কোথায়?
চালের গোডাউনে বসে আছেন।
দুপুরে খাওয়া যাবার পর, বাউল ঠাকুর গান শুরু করলেন। ভূমিকা করে বললেন, মহুয়া নদীর ঘাটে জল আনতে গেছে। নদীয়ার চাঁদ মহুয়াকে ভালোবাসা জানিয়েছে। মহুয়া সুন্দরী। সে রেগে নদীয়ার চাঁদকে বলেছে,
লজ্জা নাই, নির্লজ্জ ঠাকুর, লজ্জা নাইরে তর,
গলায় কলসী বাইন্ধ্যা জলে ডুইব্বা মর।
তারপর?
নদীয়ার চাঁদ তখন বলে,
কোথায় পাইবাম কলসী কন্যা, কোথায় পাইবাম দড়ি, তুমি হও গহীন গাঙ, আমি ডুইব্যা মরি।
অবিনাশ মল্লিক গোডাউন থেকে বেরিয়ে বাউল ঠাকুরের সঙ্গে দেখা করতে এলেন। বললেন,
আপনি এলে, আমার মেয়েটা ভালো থাকে। ওর মা নেই। পুরো সংসারটা ও সামলায়। আমি তো বাইরে বাইরে থাকি। আপনি তো ভবিষ্যৎ বলতে পারেন,
নীলু মায়ের ভবিষ্যৎ কেমন? কেমন বর হবে ওর?
বললেন, ওকে নিয়ে চিন্তা করবেন না। মাসখানেকের মধ্যেই ওর বিয়ের সম্বন্ধ আসবে। পূর্বা গ্রামের জমিদার পুত্রের সঙ্গে ওর বিয়ে হবে। আপনাকে পাত্র খুঁজতে হবে না মল্লিক মশাই।
ওরাই আসবে।
সত্যি সত্যি ঘটক মশাই এসে ও বাড়ি সম্বন্ধ নিয়ে এলো। পাত্রপক্ষের মেয়েকে দারুন পছন্দ।
নীলাঞ্জনা যথেষ্ট সুন্দরী। টানা টানা চোখ, মুখে সবসময় হাসি। অদ্ভুত পবিত্রতা সর্বক্ষণ ঘিরে থাকে তাঁকে। এই প্রথম পাত্রপক্ষের মুখোমুখি হয়েছিল নীলাঞ্জনা। এক দেখাতেই বিয়ে।পাত্র সুপর্ণকান্তি একবার দেখেই পছন্দ করে গেল। ধূমধাম করে বিয়ে হয়ে গেল ওদের।
সুপর্ণ শহরের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট।
অনেক পড়াশুনা করার সুপর্ণকান্তি কিন্তু নীলাঞ্জনার প্রেমে পড়ে গেলেন, অচিরেই।
এ তো এক অদ্ভুত মেয়ে। সংসারটাকে আঁকড়ে ধরে আছে।
কোনো চাহিদা নেই। গ্রামের সবাই এর কাছে কদিনেই মা জননী হয়ে গেছে।
আশ্বিন মাস।
অম্বিকা পূজা সমগ্র ভুবনে।
সুপর্ণকান্তিদের চন্ডীমন্ডপে পুলিন পাল ঠাকুর গড়তে শুরু করলেন। সকালের সোনালী আলো উঠোনে এসে পড়ল। শিউলি ফুলে উঠোন ভরে গেল। পেছনের মাঠে সাদা কাশফুলের উপর উদাস হাওয়া। নদীতে খড়বোঝাই নৌকো।
সবে কলকাতা থেকে সুপর্ণ কান্তি বাড়ি ফিরেছেন। পুজোর ছুটি। শহরে যারা চাকরি করতে যান, সবাই ঘরে ফিরছে।
নীলাঞ্জনা বলল, আমার একটা ইচ্ছের কথা তোমাকে বলতে পারি?
কি?
পুজোতে গরীব মানুষদের সবাইকে বস্ত্র বিতরণ করতে চাই।
খুব ভালো কথা।
আরেকটা কথা।
কি?
সবাই এখানে এ কদিন খাওয়া দাওয়া করবে।
তোমার তাই ইচ্ছে নাকি?
খুব ইচ্ছে।
তাই হবে।
খুব ধূমধাম করে পুজো হলো। গরীব মানুষের মুখে হাসি দেখে নীলাঞ্জনার মন ভরে গেল। সুপর্ণকান্তি
পড়াশুনোর কারণে শহরে বেশি থেকেছেন। শহুরে মেয়েদের মধ্যে এই আন্তরিকতা কখনো দেখেননি।
এই নিজস্ব ভালোলাগাটা তিনি কখনো কারো কাছে প্রকাশ করেননি। আসলে, উপলব্ধি করতে তাঁর ভালো লাগে। অনেকের মতো তিনি উচ্ছ্বসিত হতে পারেন না। তাঁর খালি মনে হয়, আমার ভালো লাগাটা আমার নিজস্ব থাক। তা সবাইকে ঢাক পিটিয়ে বলতে যাব কেন?
নীলাঞ্জনা বাবার খবর নেয়। রাতে ফোনে প্রশ্ন করে,
তুমি প্রেশারের ট্যাবলেট খেয়েছো? রাত জেগে কাজ করছো না তো?
মল্লিক মশাই হাসেন। বলেন, আমার পাগলি মেয়ে,
আমি ঠিক আছি, তুই ও বাড়িটা সামলা।
আজকাল মায়ের কথা খুব মনে পড়ে নীলাঞ্জনার। মা না থাকলে, পৃথিবীটা অন্ধকার। মা মানে বিশাল আশ্রয়। যার কাছে সব কথা বলা যায়। নিজের আনন্দের কথা, নিজের কান্নার কথা, একমাত্র মায়ের কাছে সবকিছু উজাড় করে দেওয়া যায়।
কতদিন হল, সেই মা উষা দেবী ওকে একলা ফেলে চলে গিয়েছেন।
কদিন ধরে শরীরটা খারাপ হয়েছিল নীলাঞ্জনার। সুপর্ণকান্তি ডাক্তার ডেকেছিলেন। পরীক্ষা নিরীক্ষা করে ডাক্তারবাবু হাসলেন। তারপর সুপর্ণকান্তির দিকে চেয়ে বললেন, একটা গুড নিউজ দিচ্ছি। আপনি বাবা হতে চলেছেন।
কয়েক মাস পরে নীলাঞ্জনা মা হয়েছে। কোলে ফুটফুটে শিশু। চাঁদের আলোর মতো তাঁর মুখ।
ওকে দেখলে প্রাণ জুড়িয়ে যায়। মাতৃত্বের স্বাদ আলাদা।
নীলাঞ্জনা ওর দিকে তাকিয়ে মনে মনে বলে, আমার পৃথিবী, আমার আকাশ। রবি ঠাকুরের কবিতার লাইন মনে পড়ে, নীলাঞ্জনা বলে, আমার মনের মাঝে ইচ্ছে হয়ে ছিলি!
বাড়ি ফিরে সুপর্ণকান্তি বলেন, ও কার মতো হয়েছে বলো তো?
তোমার মতো।
তাই কি?
সবাই তো তাই বলছেন।
তুমি কি বলছো?
আমি বলছি, ও যেন ওর বাবার মতো পন্ডিত আর ভালো মানুষ হয়।
সুপর্ণকান্তি হেসে ফেললেন।
রাতে দোতলায় জানালার কাছে ওকে মাঝখানে রেখে সুপর্ণকান্তি আর নীলাঞ্জনা আধ শোয়া অবস্থায় কথা বলছিল।
তখন চাঁদের আলো ওদের জানালা দিয়ে বিছানার উপর এসে পড়েছে।
নীলাঞ্জনা বলল, আমি মা হয়েছি। আমার মাকে খুব মনে পড়ছে। কী ভালো যে বাসতেন। কিভাবে যে আগলে রেখেছিলেন।
সব মায়েরাই তো তাই। পৃথিবীর একমাত্র স্বার্থশূন্য সম্পর্ক। এত ভালোবাসা, এত আত্মত্যাগ মা ছাড়া
আর কেউ কখনো করতে পারেন না।
তুমি শুয়ে পড়ো। তোমার সকালে অফিস আছে।
সুপর্ণকান্তি ঘুমিয়ে পড়লেন।
নীলাঞ্জনা জানালা দিয়ে আকাশের তারাদের দিকে চাইল। যেন ওই তারাদের ভিড়ে মাকে খোঁজা। তারপর মনে মনে বলল, মাগো, যেখানেই থাকো, ভালো থাকো। আর আমার সঙ্গে থেকো। মানুষকে ভালোবাসার কথা তুমি তো আমাকে শিখিয়েছিলে।
আজ আমি মা হয়েছি। আমি যেন তোমার মতো আদর্শ মা হতে পারি।
তখন শীতের শুরু। ঘরে শীতল বাতাস প্রবেশ করতেই, ওর চোখে ঘুম এলো।
ঠিক ঘুম নয়, ঘুমের মতো আচ্ছন্ন অনুভূতির মধ্যে মনে হল, মা উষা দেবী ওর শিওরে এসে দাঁড়িয়েছেন।
আমি তো তোর সঙ্গে সব সময় থাকি, সোনা। তোর সব কাজ আমি দেখতে পাই। ভালো কাজের মধ্যে দিয়েই তুই তো ভালো মা হয়ে উঠেছিস।
তোর ভালো হবে রে মা! কোনো ভয় নেই।