শীতল হাওয়ায় কবিতা পাঠের শব্দে ভরা হলঘর। সাহিত্য সম্মাননা অনুষ্ঠানের মঞ্চে আলো ঝলমল করছে। স্নিগ্ধা নীল শাড়িতে ধীরে ধীরে প্রবেশ করতেই এক মুহূর্তের জন্য যেন সময় থমকে দাঁড়াল। নীল শাড়িতে স্নিগ্ধাকে দেখে মনে হচ্ছিল যেন আকাশ থেকে নেমে আসা কোনো নীল প্রজাপতি। চারদিক থেকে প্রশংসার ঝড় উঠল।
কিন্তু সেই প্রশংসার ভিড়েও স্নিগ্ধার চোখে লুকিয়ে ছিল গভীর এক বিষাদ। স্বপ্নময় চোখের তারায় লুকানো কষ্টের ছায়া কেউ খেয়াল করেনি। তার হাসি ছিল উজ্জ্বল, চঞ্চলা হরিণীর মতো, কিন্তু সেই হাসির আড়ালে ছিল এক বিষণ্ণতা, যা কেবল সে নিজেই জানে।
এই অনুষ্ঠানে আসা তার জন্য ছিল এক বড় চ্যালেঞ্জ। নিজের লেখালেখির জগতে নতুন, কিন্তু তার কবিতাগুলোর প্রতিটি শব্দ যেন পাঠকদের হৃদয়ে গভীর রেখাপাত করত। স্নিগ্ধা ধীরে ধীরে নিজেকে সাহিত্যের জগতে প্রতিষ্ঠা করছিল।
অনুষ্ঠান চলাকালীন, হঠাৎ মঞ্চ থেকে কারো কবিতার উচ্চস্বরে আবৃত্তির শব্দ কানে এলো। সেই শব্দ স্নিগ্ধার মনোযোগ কেড়ে নিল। মনে হলো, এত জোরে আবৃত্তি করার কি প্রয়োজন? কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, সেই সুরের ধ্বনি তার মনের কোণে এক অদ্ভুত প্রভাব ফেলল।
অনুষ্ঠানের দায়িত্ব পালন করতে করতে স্নিগ্ধা ব্যস্ত হয়ে পড়ল। অতিথিদের আপ্যায়নে ছুটে বেড়াচ্ছিল, আর তার বন্ধুরাও তাকে সাহায্য করছিল। এ সময় অনেকেই তার সঙ্গে ছবি তুলতে চাইছিল। স্নিগ্ধা, সহজ-সরল মনের মেয়ে, সবার ইচ্ছা মেনে হাসিমুখে ছবি তুলছিল।
তখনই বর্ণের সঙ্গে প্রথম দেখা। বর্ণও একজন লেখক। তার চোখে স্নিগ্ধাকে দেখে এক প্রশংসার ঝিলিক। সেই চোখের মুগ্ধতা স্নিগ্ধার মনে কোথাও গভীর ছাপ ফেলেছিল। সেই মুগ্ধতা ধীরে ধীরে পরিণত হলো ঘনিষ্ঠতায়।
বর্ণের কথাগুলো ছিল মধুর, তার ব্যক্তিত্ব ছিল আকর্ষণীয়। স্নিগ্ধা ধীরে ধীরে তার প্রতি দুর্বল হয়ে পড়ল। বর্ণের প্রতি গভীর বিশ্বাস এবং ভালোবাসায় নিজের সব কিছু উজাড় করে দিল সে। কিন্তু সময়ের সঙ্গে বুঝতে পারল, বর্ণের ভালোবাসা কেবল দেহের চারপাশে ঘোরে।
প্রতিবার যখন স্নিগ্ধা তার আবেগ, স্বপ্ন বা ভেতরের অনুভূতি শেয়ার করতে চেয়েছে, বর্ণ তা পাশ কাটিয়ে গেছে। একদিন স্নিগ্ধা সাহস করে জিজ্ঞাসা করল,
“তুমি কি সত্যি আমাকে ভালোবাসো?”
বর্ণ নিস্পৃহ ভঙ্গিতে উত্তর দিল,
“তোমার মধ্যে প্রেমের গভীরতা পাই না। তুমি খুব সাধারণ।”
স্নিগ্ধার মনে কথাগুলো তীরের মতো বিদ্ধ করল। এতদিন ধরে যা সে বর্ণের জন্য করেছে, সবই যেন অর্থহীন হয়ে গেল। সে বুঝতে পারল, বর্ণের ভালোবাসা কেবল প্রয়োজন মেটানোর আকাঙ্ক্ষা ছিল।
স্নিগ্ধা কোনো অভিযোগ করল না। তার ভালোবাসা এতটাই নিঃস্বার্থ ছিল যে সে বর্ণকে মুক্তি দিল।
মাসের পর মাস কেটে গেল। সম্পর্ক ছিন্ন করার পর স্নিগ্ধা নিজেকে নতুন করে গড়তে শুরু করল। তার কবিতাগুলো হয়ে উঠল আরও গভীর, আরও শক্তিশালী। তার শব্দে ফুটে উঠল বেদনা, কিন্তু সেই বেদনা তাকে অন্য এক উচ্চতায় নিয়ে গেল।
বর্ণ? সে অন্য কারো সঙ্গে নতুন প্রেমে মগ্ন। নতুনত্বের সুখে মেতে ওঠা বর্ণ মঞ্চে উঠে তার নতুন কবিতার বই নিয়ে কথা বলছে। তার কণ্ঠে আত্মবিশ্বাস, কিন্তু স্নিগ্ধা দূর থেকে দেখেও জানে, সেই আত্মবিশ্বাসের পেছনে আছে শূন্যতা।
স্নিগ্ধা আর অভিযোগ করে না। সে নিজের জীবনকে নতুন করে সাজায়, নিজের ভাঙা হৃদয়কে শক্তিতে রূপান্তরিত করে। তার কবিতা যেন এক শূন্য আয়নার মতো, যেখানে সবাই নিজের প্রতিচ্ছবি খুঁজে পায়।
এই আয়নার ভেতরেই স্নিগ্ধা নিজেকে খুঁজে পায়। তার কষ্টই তার শক্তি। তার প্রেমের গভীরতা আর সৃষ্টিশীলতার উচ্চতা এখন তাকে এক অনন্য মাত্রায় নিয়ে গেছে।
তবু মাঝে মাঝে শীতল রাতে, একাকী চাঁদের আলোয় স্নিগ্ধা ভাবতে বসে—
ভালোবাসার শূন্য আয়নায় কি কেউ কখনো তার গভীরতাকে দেখেছিল? নাকি তার ভালোবাসা শুধুই ছিল অদেখা, অমূল্যায়িত?
তবু স্নিগ্ধা জানে, সে হেরে যায়নি। তার ভালোবাসা এখন শুধু তার নিজের, তার সৃষ্টির।