বয়স হয়েছে তো, মনের বন্ধ দুয়ার খুলে মাঝে মাঝে স্মৃতিগুলো বেরিয়ে আসতে চায়। আর, পিছনের দিকে হাঁটা আমার বরাবরের অভ্যাস।
সে বড় অভাবের দিন। আমার অতি শৈশবকাল। অভাব ছিল, দারিদ্র ছিল। দু চোখে অনেক স্বপ্ন ছিল, সবুজ প্রকৃতির মধ্যে মানুষ হচ্ছিলাম বলে স্বপ্নেরা দিগন্তে যখন তখন ডানা মেলত। তখন আকাশে রংবেরঙের ঘুড়ি উড়ত অনেক।
মাটির ভাড়া বাড়িতে থাকতাম। উঠোনে ছিল একটি বিরাট ডেয়ো ফলের গাছ। সামনে ঘন বাঁশঝোপ।
ডানদিকে সরষে খেত। নারকেল গাছের শ্রেণী, মাঠের দু’ধারে।
শিশির ভেজা সকাল আসে স্বপ্নের মত। বর্ষার দিনে কাকু মাঠ থেকে ভিজে শালিক পাখি তুলে আনে। আমাকে ডেকে বলে, বাবু, একে বাঁচাতে হবে।
তখন ক্লাস টু এ পড়ি। আমাদের পেছনের মাটির ঘরে এক দম্পতি ভাড়া এলেন।
ভদ্রলোকের নাম বিশ্বনাথ মিশির। ওনারা খ্রিস্টান।
এসব পরে জেনেছিলাম। উনি বাটা কোম্পানিতে কাজ করতেন। রোগাসোগা দীর্ঘকায় মানুষ। কম কথা বলেন। কিন্তু মানুষ খুব ভালোবাসেন। বিশেষ করে বাচ্চারা তাঁর নয়নের মনি।
তিনি আমাদের একদিন ডেকে বললেন, বাড়ির পাশে পুকুরপাড়ের রাস্তায় আমাদের সবাইকে প্যারেড করা শেখাবেন।
সেইমত প্রতিদিন আমরা তাঁর নির্দেশ মত দীর্ঘ লাইন করে প্যারেড শিখতাম। খুব যত্ন করে ভালোবেসে তিনি আমাদের শেখাতেন।
অচিরেই তিনি আমাদের সকলের কাছে বিশ্বনাথ কাকু হয়ে গেলেন। কাকিমা দেখার মত সুন্দরী। তাঁর দেবী প্রতিমার মত সুন্দর মুখটা যে একবার দেখেছে, সে কখনো ভুলতে পারবে বলে মনে হয় না। তিনি কোনদিন আমাদের সঙ্গে কথা বলেননি।
বিকেলে বাড়ির গেটের কাছে দাঁড়িয়ে থাকার সময় আমাদের ছোটদের কাউকে দেখলে, তিনি স্মিত হাসি হাসতেন। জরির কাজ করা সাদা কিংবা ঘিয়ে রঙের শাড়িতে তাঁকে কি অপরূপা দেখাতো।
মানুষের শৈশবে যে কি অমলিন মুগ্ধতা জড়িয়ে থাকে। স্বপ্নের মতো দিনগুলো কেটে যাচ্ছিল বেশ।
বিশ্বনাথ কাকু আমাদের সকলের পড়াশোনার খবর নিতেন। আমি, কুদুর, পিতিশ, তপু, কালু, বৈজু ও
অঞ্জুদি, আমরা সবাই তাঁর ভক্ত হয়ে গিয়েছিলাম।
বিশ্বনাথ কাকুর পরিচালনায় আমরা একটা সুশৃংখল জীবনযাপনের অভ্যাস রপ্ত করে নিয়েছিলাম।
একদিন আমাকে বললেন, ইংরেজিতে তোর কোন অসুবিধা হলে, আমাকে বলবি,
কিভাবে মানুষের সঙ্গে কথা বলতে হয়, বড়দের কিভাবে শ্রদ্ধা জানাতে হয়, বিশ্বনাথ কাকু ঠান্ডা গলায় আমাদের এইসব বোঝাতেন। ছোটবেলায় এই মানুষটা আমাদের জীবনের পরিকাঠামোটা
ঠিক করে দিয়েছিলেন।
আমাদের মধ্যে দুরন্তপনা দেখলে, তিনি মৃদু গলায় বলতেন, বাবা, এমনটা করতে নেই।
তাঁর কথার মধ্যে এত ভালোবাসা লেগে থাকত, দ্বিতীয় দিন আর কেউ দুরন্ত আচরণ করেনি।
বড়দিনের দিন কাকুর বাড়িতে আমাদের নেমন্তন্ন হলো। গিয়ে দেখি, কত কত মহার্ঘ খাবার। দামি কেক, পেস্ট্রি।
গরীব বাড়ির ছেলে আমরা। এসব খাবার আমরা কখনো চোখে দেখিনি। কাকিমা যত্ন করে আমাদের সবাইকে খাওয়ালেন। বাড়ির সকলের জন্য আমাদের হাত দিয়ে কেক পাঠিয়ে দিলেন।
জীবনের সুখের সময় অল্প। জীবনে ভালো মানুষের দেখা পাওয়া, ঈশ্বরের আশীর্বাদ ছাড়া হয়না।
সেদিন সন্ধ্যেবেলা মাদুর পেতে উঠোনে পড়তে বসেছি। সাদা দুধেল জোছনায় ধুয়ে যাচ্ছে পৃথিবী। ঠাকুরমা তালপাতার পাখা দিয়ে বাতাস করে যাচ্ছেন আমাদের।
হঠাৎ রেনু মাসিমা খবর দিলেন, বিশ্বনাথ কাকু অসুস্থ। মা এবং পাশের বাড়ির মাসীমারা সবাই ছুটলেন বিশ্বনাথ কাকুর বাড়ি।
ডাক্তার এলেন। সমস্ত রকম চেষ্টা চরিত্র হলো। কিন্তু সেদিন গভীর রাতে আমাদের সকলের প্রিয় মানুষটা না ফেরার দেশে চলে গেলেন।
পৃথিবীতে এমন এক একজন মানুষ এভাবে আসেন, যারা নীরবে নিঃশব্দে ভালবাসার পৃথিবী তৈরি করে দিয়ে যান।
বিশ্বনাথ কাকু চলে গেলেন। বুকটা খাখা খালি হয়ে গেল। ছোটবেলায় পাওয়া আঘাতগুলো মানুষ কখনো ভুলতে পারেনা। এখনো তাঁর কমান্ড গুলো কানে বাজে।
পরদিন যখন ওনাকে সমাধি ক্ষেত্রের দিক নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল, তখন আমরা ছোটরা সবাই ওনার কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম।
অজস্র সাদা ফুলে ঢেকে গিয়েছিল তাঁর শরীর। তাঁর ভালোবাসার মুখটা আমরা দেখছিলাম। তখন ছোট বয়স। বারবার মনে মনে প্রশ্ন করছিলাম, কেন পৃথিবী থেকে ভালো মানুষগুলো এত তাড়াতাড়ি চলে যান।
যখন তিনি বিদায় নিচ্ছেন, বাড়ির গেটে ফুল বাগানের পাশে দাঁড়িয়ে কাকীমা। চোখে জল। জীবনে এমন বিষণ্ণ মুখ আমি কখনো দেখিনি।
তাই বলছিলাম, বয়স হয়েছে তো, বয়স হয়ে গেলে মানুষ পিছন ফিরে চায়। আজ সারাটা সকাল ধরে কিভাবে যেন শৈশবের দিনগুলো মনে এসে গেল, এবং সঙ্গে অবধারিতভাবেই বিশ্বনাথ কাকু।
তোমাকে আমরা ভুলিনি কাকু। সত্তরোর্ধ্ব বয়সে আজো আছো তুমি আমাদের মনের মধ্যে রয়েছো।
তোমার গলা কানে বাজছে,
লেফট রাইট, লেফট রাইট।