হিন্দু মা, আমি মুসলিম ছেলে ও দূর্গা পূজা
সিলেটের সেই সন্ধ্যাটি ছিল অন্যরকম। আকাশে মেঘের আড়ালে সূর্য লুকোচুরি খেলছিল, আর আমার হৃদয়ে উঠছিল আবেগের ঢেউ। আমার মা মেজিস্ট্রেটের সামনে জবানবন্দি দেওয়ার পর আমার সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জনাব নাজমুস সাদাত স্যারের সঙ্গে ফেরার পথে মায়ের সঙ্গে দীর্ঘদিন পর গল্পে মেতে উঠলাম। তিনি একজন মুক্তিযোদ্ধা ও ব্রাম্মন পরিবারের স্ত্রী!
মা, আমার হিন্দু মা, যিনি আমাকে সবসময় ভালোবাসার ছায়ায় আগলে রেখেছেন, তিনি বারবার চারপাশে তাকাচ্ছিলেন। তাঁর চোখে ভয়, কেউ দেখে না ফেলে! সমাজের দৃষ্টি, তার নির্মম বিচার, যেন মায়ের মনে ছায়া ফেলছিল।
ফেরার পথে আমি মাকে দুর্গা পূজার হাদিয়া হিসেবে কিছু টাকা দিতে চাইলাম। মা প্রথমে নিতে অস্বীকার করলেন। আমি বললাম, “মা, তুমি যেমন ঈদে আমাকে নতুন কাপড়ের জন্য টাকা পাঠিয়েছিলে, তেমনি আমিও তোমাকে পূজার জন্য দিচ্ছি। নতুন কাপড় কিনো, আত্মীয়-স্বজনদের সঙ্গে ভাগ করে নিও। ভাইকেও তো সাত হাজার টাকা দিয়েছি মার্কেটিংয়ের জন্য।” মায়ের চোখে জল এলো। সেই জল ছিল ভালোবাসার, গর্বের, আর হয়তো একটু অভিমানের।
আমি মাকে বোঝাতে শুরু করলাম, ধর্মের সীমানা, বিশ্বাসের পথ, আর মানুষের হৃদয়ের কথা। বললাম, “পূজা-অর্চনা ধর্মীয় ব্যাপার, মা। মুসলমানরা নামাজ পড়বে, হিন্দুরা পূজা করবে—এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সমস্যা হয় তখন, যখন এক ধর্মের ইবাদত আরেক ধর্মের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়। মুসলমানদের নামাজ হিন্দুদের ওপর চাপানো যেমন অন্যায়, তেমনি হিন্দুদের পূজা মুসলমানদের ওপর চাপানোও অন্যায়।”
তারপর আমি মাকে নবিজি ﷺ-এর কাহিনি শোনালাম। মক্কার মুশরিকরা যখন বলেছিল, “এক বছর আমরা তোমার আল্লাহর ইবাদত করব, আরেক বছর তুমি আমাদের মূর্তির পূজা করো,” তখন নবিজি ﷺ দৃঢ়ভাবে তা প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। তখনই নাযিল হয়েছিল সুরা কাফিরুন: *“বলো, হে কাফিররা! আমি ইবাদত করি না, যাদের তোমরা ইবাদত করো। তোমরাও ইবাদত করো না, যাকে আমি করি। তোমাদের দ্বীন তোমাদের জন্য, আমার দ্বীন আমার জন্য।”*
মা মন দিয়ে শুনলেন। তারপর নরম গলায় বললেন, “বাবা, অনেক মুসলমান তো পূজায় যায়, প্রসাদ খায়, আনন্দ করে। তুমিও এসো।” আমি মৃদু হেসে বললাম, “মা, কেউ কেউ ভাবে এতে ক্ষতি নেই। কিন্তু শিরক আল্লাহর কাছে সবচেয়ে বড় অন্যায়। একজন তাওহিদবাদী মুসলিম কীভাবে মূর্তিপূজার উৎসবে অংশ নিতে পারে? এটা আল্লাহকে অসম্মান করা। যেমন কোনো সন্তান তার বাবাকে অপমানিত হতে দেখলে আনন্দ পায় না, তেমনি আমিও আল্লাহর অপমান হতে কখনো আনন্দ পাব না। তুমি হিন্দু, তুমি পূজা করো। আমি মুসলমান, আমি আমার ঈমান রক্ষা করব।”
আমি মাকে কুরআনের আয়াত শোনালাম: *“নিশ্চয়ই আল্লাহর সাথে শিরক করা সবচেয়ে বড় জুলুম।”* আর বললাম, রাসুলুল্লাহ ﷺ ইরশাদ করেছেন, *“যে ব্যক্তি আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারও কাছে প্রার্থনা করে এবং সে অবস্থায় মারা যায়, সে জাহান্নামে প্রবেশ করবে।”*
মা চুপ করে শুনলেন। তারপর নরম গলায় বললেন, “বাবা, বুঝেছি। আল্লাহ তোমাকে হেফাজত করুন। আমি তোমার জন্য দোয়া করি।” আমার গলা ভারী হয়ে এলো। বললাম, “মা, আমিও তোমার জন্য দোয়া করি। তুমি ভালো থেকো, সুখে থেকো।”
ফেরার পথে, আমি মায়ের মাথায় হাত রাখলাম। হৃদয় থেকে উঠে এলো কালেমার দোয়া। আমি মনে মনে প্রার্থনা করলাম, আল্লাহ যেন মাকে হেদায়েত দেন, তাঁর জীবনকে শান্তি আর সুখে ভরিয়ে দেন। মায়ের চোখে তখনো জল, কিন্তু সে জল আর শুধু দুঃখের নয়—তার মধ্যে ছিল ভালোবাসা, সম্মান, আর এক অদ্ভুত স্নিগ্ধতা।
সেই মুহূর্তটি আমার হৃদয়ে চিরকাল গেঁথে থাকবে। মা আর আমি, দুই ধর্ম, দুই বিশ্বাস—কিন্তু ভালোবাসার বন্ধনে এক।