আজ এক মাসের বেশি হয়ে গেল রক্তিম আর মেঘলার, একে অপরের সাথে কোনো কথা নেই। যদিও এটা নতুন নয়। ইদানিং টুক কথা নিয়ে তাদের মধ্যে ঝগড়া হয়। আগে ঝগড়া হত না এমনটা নয়, আগের ঝগড়ার মধ্যে একটা ভালোবাসা লুকিয়ে থাকত। ঝগড়ার রেস থাকতো কয়েক ঘণ্টা, এখন সেটা দিন পেরিয়ে মাসে পরিণত হয়েছে। আগে টাকা খুব বেশি না থাকলেও সুখ ছিল অফুরান। প্রতি সপ্তাহে রবিবার ঘুরতে যাওয়ার সময় ছিল, মুভি দেখার নেশা ছিল। আর এখন যত দিন যাচ্ছে তাদের সম্পর্কের মধ্যে দূরত্বটা ততই বেড়ে যাচ্ছে ক্রমাগত।
দুজনের সম্পর্কের শুরুটা হয়েছিল বেশ অন্য রকম ভাবে। রক্তিম তখন এম. এ ফাস্ট ইয়ার। আর মেঘলা বি.এ সেকেন্ড ইয়ার। কলেজের অনুষ্ঠানে অদূরে দাঁড়িয়ে থাকা, নীল শাড়ি পরা একটি মেয়েকে দেখে ভালো লাগে রক্তিম এর। তার দীঘল চোখদুটিতে মানান সই কাজল, ঠোঁটে হালকা গোলাপী লিপস্টিক, কপালে ছোটো একটা টিপ, গলায় সুন্দর হার। খোঁপার পাশে গোঁজা লাল গোলাপ। কি অপরূপ লাগছে তাকে। এরপর থেকে কারণে অকারণে দুজনের দেখা, শুরু হয় সম্পর্ক। মেঘলার ফ্ল্যাটবাড়ি। অন্যদিকে রক্তিম এর মাটির ঘর, টালির চাল। এতো কিছু অমিলের মধ্যেও দীর্ঘ চার বছর প্রেমের পর, দুটি হৃদয় এক হয় একপ্রকার মেঘলার বাড়ির অমতেই।
বিয়ের মাস দুই পর রক্তিম phd শেষ করে, কলকাতার একটি কলেজের প্রফেসর হিসাবে যুক্ত হয়। চাকরির সূত্রে গ্রাম থেকে চলে আসতে হয় শহরে। অন্যদিকে বিয়ের এক বছর এর মধ্যেই মেঘলাও চাকরি পায় কলকাতার সরকারি একটি উচ্চমাধ্যমিক স্কুলে। শুরু হয় দুজনের ব্যস্ততা। বাড়তে থাকে দূরত্ব।
বর্ষাকাল। শনিবার। আকাশ ভাঙ্গা বৃষ্টি মাথায় নিয়ে কলেজ থেকে ফিরে এসে নিজের রুমে প্রবেশ করে রক্তিম। মেঘলাও স্কুল থেকে ফিরে পাশের ঘরে ঢুকে গেল। দুটি মানুষ এক ছাদের নিচে থাকলেও, ঝগড়ার পর এক ঘরে থাকে না ইদানিং। হঠাৎ করেই ফোনটা বেজে ওঠে রক্তিমের। মায়ের ফোন। স্বাভাবিক ভাবে কথা বলার চেষ্টা করে।
– হ্যাঁ মা বলো, কেমন আছো?
– ভালো আছি। তুই কেমন আছিস বাবা? বৌমা কি করছে? ফিরেছে?
– আমি ভালো আছি মা। তোমার বৌমা পাশের ঘরে আছে। এই স্কুল থেকে ফিরল সবে, রেস্ট নিচ্ছে।
ছেলের সাথে নানা কথা বলার পর ফোনটা রাখে মৃদুলা দেবী। ছেলে হাসি মুখে কথা বললেও, ছেলে আর বৌমার মধ্যে যে একটা ঝামেলা চলছে সেটার আঁচ করতে অসুবিধা হলো না তার। যতই হোক মা, ছেলের গলা শুনে বুঝবে পারবে না এও সম্ভব…!
দেখতে দেখতে আজ চার বছরে পা দিল রক্তিম আর মেঘলার বিবাহ। রবিবার। সারা দিন বাড়িতে থাকলেও তাদের বিবাহ বার্ষিকী নিয়ে দুজনের কোনো মাথা ব্যথা নেই। সম্পর্কটায় যেখানে ভাঙনের মুখে, সেখানে বিবাহ বার্ষিকী পালন করাটা হাস্যকর। কালকে সকাল ১০ টায় অ্যাডভোকেট স্যান্যাল এর সাথে ডিভোর্স নিয়ে দেখা করবে দুজনে। Whatsapp জুড়ে ঢুকেই চলেছে মেকি শুভেচ্ছা বার্তা।
ঘড়িতে তখন সন্ধ্যা সাতটা। হঠাৎ করে বেজে ওঠে কলিং বেল। মেঘলা দরজা খুলে দেখে শ্বশুর আর শ্বাশুড়ি মা এসেছেন। এখানের ফ্ল্যাটে দুটি ঘর থাকা সত্বেও, ওনারা গ্রামেই থাকেন। রক্তিম অনেক জোর করার পরেও আসেননি। ওনাদের সোফায় বসিয়ে ফ্রিজ থেকে ঠান্ডা জল এনে দেয় মেঘলা। রক্তিম এসে কথা বার্তা বলতে থাকে। তাদের এই ডিভোর্স এর কথা ওনারা কেউই জানেন না। অসময়ে তাদের এই আগমন দুজনকেই বিপদে ফেলল খানিকটা। কথাবার্তার মাঝে মৃদুলা দেবী বলে ওঠেন – বুঝলি বাবু, অনেক ভেবে দেখলাম তুইও প্রায় বলিস এখানে এসে থাকতে তাই মাস চারেক আমরা এখানেই থাকবো। আর জানো বৌমা আমার শ্বাশুড়ি মা বলতো – যাদের যত বেশি ঘর, স্বামী স্ত্রীর ঝগড়ার পর তাদের দূরত্ব তত বেশি।
রক্তিম আর মেঘলার বুঝতে অসুবিধা হলো না, তারা কিছু একটা সন্দেহ করে তবেই এসেছেন।
রাতে খাওয়া দাওয়া সেরে একটি ঘরে রক্তিম এর বাবা মা শুতে চলে গেল। অনিচ্ছা সত্বেও রক্তিম আর মেঘলা একই রুমে প্রবেশ করল। দুজনে দুইদিকে মুখ করে ঘুমানোর ভান করে শুয়ে রইলো। প্রায় এক মাস পর, দুটি শরীর আজ এক বিছানায়। অনেকটা কাছাকাছি, পাশাপাশি।
বাইরে শুরু হয়েছে অঝোরে বৃষ্টি আর বজ্রপাত। বজ্রপাত এর শব্দে মেঘলার বরাবরই ভয়। একটা প্রচন্ড জোড়ে বাজ পড়তেই, ভয় পেয়ে রক্তিমকে জড়িয়ে ধরে মেঘলা। দীর্ঘদিন পর ভালোবাসার মানুষটিকে এতটা কাছে পেয়ে দূরে সরাতে পারেনি রক্তিমও। সেতো বরাবর চেয়েছে ঝামেলাটা মিটিয়ে নিতে। কিন্তু মেঘলা বরাবর একগুঁয়ে, জেদী। তাইতো মেঘলাকে এতটা কাছে পেয়ে আরো অনেকটা কাছে টেনে নিল রক্তিম, অনেকটা…।
ভুল বোঝাবুঝি শেষে ফুরফুরে একটি নতুন সকাল। ঘুম থেকে উঠতে দুজনেরই খানিকটা দেরি হয়ে গেল। দরজা খুলে বেরিয়ে আসতেই মৃদুলা দেবী ছেলে আর বৌমার দিকে চায়ের কাপটা এগিয়ে দেয়। দুজনকে বেশ হাসি খুশি দেখাচ্ছে। বৌমার চোখে মুখে একটা লাজুক ভাব। বৌমার কাছে গিয়ে কানে কানে মৃদুলা দেবী বললেন – এই বার কিন্তু আমার একটা নাতি নাতনী চাই…।