জাতীয় সংসদে আগামীকাল থেকে শুরু হচ্ছে বাজেট অধিবেশন। সংবিধানের ৭২ অনুচ্ছেদের (১) দফায় দেয়া ক্ষমতাবলে প্রেসিডেন্ট এরইমধ্যে এই অধিবেশন আহ্বান করেছেন। ওইদিন বিকাল ৫টায় দ্বাদশ জাতীয় সংসদের তৃতীয় অধিবেশন এবং প্রথম বাজেট অধিবেশন শুরু হবে। অধিবেশনের শুরুতে সভাপতি শোক প্রস্তাব, সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য নির্বাচন এবং সমপ্রতি ভারতে নিহত হওয়া এমপি আনোয়ারুল আজিম আনারের ওপর শোক প্রস্তাবের আলোচনা অনুষ্ঠিত হবে। এরপরই রেওয়াজ অনুযায়ী অধিবেশন মুলতবি হবে। প্রায় একমাস ধরে চলবে এ অধিবেশন। বাজেট আলোচনার পাশাপাশি এবারের অধিবেশন উত্তপ্ত থাকবে আরও তিন ইস্যু নিয়ে। এর মধ্যে রয়েছে- ভারতে সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিম আনার হত্যাকাণ্ড, সাবেক সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদ ও পুলিশ প্রধান বেনজীর আহমেদ এর দুর্নীতি। সংসদে প্রধান বিরোধী দল জিএম কাদেরের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টির পক্ষ থেকে এরই মধ্যে সংসদে বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনার কথা ঘোষণা দেয়া হয়েছে। পাশাপাশি স্বতন্ত্র ও সরকারদলীয় এমপিরাও এ নিয়ে কথা বলতে চান বলে জানান। তবে শেষ মুহূর্তে বিশেষ কোনো নির্দেশনা না এলে বাজেট অধিবেশনের প্রায় পুরোটা সময় এই তিন ইস্যু নিয়ে উত্তপ্ত থাকতে পারে সংসদ অধিবেশন। সংশ্লিষ্টরা জানান, ৫ ভাবে সংসদে ওই তিন ইস্যু নিয়ে এমপিরা আলোচনা বা উত্থাপন করতে পারেন। প্রথমত, প্রশ্নোত্তর পর্বে এমপিরা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীর কাছে জানতে পারেন, দ্বিতীয়ত-নির্ধারিত বুধবারে প্রধানমন্ত্রীর প্রশ্নোত্তর পর্বে প্রধানমন্ত্রীর কাছেও এ নিয়ে প্রশ্ন করতে পারেন।
সেটা লিখিত বা সম্পূরক প্রশ্নের মাধ্যমে হতে পারে। তৃতীয়ত, পয়েন্ট অব অর্ডার বা অনির্ধারিত আলোচনায় অংশ নিয়েও ইস্যুগুলো নিয়ে এমপিরা সংসদে কথা বলতে পারেন। চতুর্থত, আলোচিত বিষয়গুলো সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীর কাছে বিবৃতি দাবি করতে পারেন এমপিরা। পঞ্চমত, বাজেট আলোচনায় অংশ নিয়ে তারা তিন ইস্যু নিয়ে বক্তব্য রাখতে পারেন। এ প্রসঙ্গে বিরোধী দলীয় চিফ হুইপ মুজিবুল হক চুন্নু মানবজমিনকে বলেন, দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতি নিয়ে আমরা সংসদে কথা বলবো। এর মধ্যে ওই তিন ইস্যু আলাদা কিছু নয়। এছাড়া অধিবেশনের দিন সংসদীয় দলের বৈঠক করবো। সেখানে আমরা কোন কোন ইস্যু নিয়ে কথা বলবো তা নির্ধারণ করা হবে। তিনি বলেন, কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলেই যে তা সত্য তা আমরা বলতে পারি না।
তবে উত্থাপিত অভিযোগ নিয়ে আমরা কথা বলতেই পারি। দলের অনেক এমপি এসব নিয়ে তাৎক্ষণিকভাবে বক্তব্য রাখতে পারেন। জনগণের পক্ষের সব ইস্যু নিয়ে আমরা সংসদে কথা বরবো। এসব নিয়ে সংসদে না বললে কোথায় বলবো। সরকার শুনুক বা না শুনুক বিরোধী দল হিসেবে আমাদের দায়িত্ব এসব তুলে ধরা। এদিকে কয়েক স্বতন্ত্র এমপি ও সরকার দলীয় এমপি’র সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে কথা বললে তারা জানান, এসব নিয়ে সংসদে অবশ্যই কথা বলা হবে। আওয়ামী লীগ দলীয় কয়েক এমপি মানবজমিনকে বলেন, সরকার দু’জনের দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে বিব্রতকর অবস্থায় আছে। তাদের ব্যক্তিগত দুর্নীতির দায় সরকার কেন নেবে। আমাদের দলের সাধারণ সম্পাদক এরই মধ্যে বিষয়টি নিয়ে পরিষ্কার বার্তা দিয়েছেন। সংসদের মাধ্যমেও আমরা এ নিয়ে জনগণকে বার্তা দিতে চায়। তবে দলের পক্ষ থেকে যদি কোনো ধরনের নির্দেশনা আসে তাহলে বিষয়গুলো নিয়ে কথা বলা হয়তো ঠিক হবে না। এদিকে সংসদ সচিবালয় জানিয়েছে, সোমবার পর্যন্ত কোনো সংসদ সদস্য ওই তিনটি বিষয় নিয়ে প্রশ্ন বা নোটিশ দেননি। এছাড়া স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বিবৃতিও দাবি করা হয়নি। তবে অধিবেশন শুরু হলে এসব বিষয় নিয়ে প্রশ্ন বা নোটিশ দেয়ার সুযোগ রয়েছে।
ভারতে বাংলাদেশের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিম আনার হত্যাকাণ্ডের পরপরই সামনে এসেছে অপরাধ জগতের সঙ্গে তার সম্পৃক্ততার প্রসঙ্গ। অন্যদিকে সেনাবাহিনীর সাবেক প্রধানের ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা এবং সাবেক পুলিশ প্রধান বেনজীর আহমেদের বিপুল পরিমাণ সম্পদ অর্জনের বিষয়টি নিয়ে দুদকের তৎপরতার ঘটনায় চলছে তোলপাড়। টানা চতুর্থ মেয়াদে ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে দলীয় সংসদ সদস্য আর সরকারের গুরুত্বপূর্ণ শীর্ষ পদে থেকে অনিয়ম-দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ার অভিযোগ ক্ষমতাসীন দলের জন্য মারাত্মক ‘ভাবমূর্তির সংকট’ হিসেবে দেখছেন অনেকে। কারণ যাদের বিরুদ্ধে এখন অভিযোগ উঠেছে তাদের প্রত্যেকেই যার যার জায়গায় বাংলাদেশের ক্ষমতা কাঠামোর প্রভাবশালী পদে অবস্থান করেছেন।
ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য খুন হওয়ার পর তার ব্যাপারে চোরাচালানের সঙ্গে সম্পৃক্ততার যে অভিযোগ আসছে তা ছিল স্থানীয় মানুষের কাছে ‘ওপেন-সিক্রেট’। পুলিশ বাহিনীর বিভিন্ন শীর্ষ পদে কর্মরত থাকার সময় ‘ক্ষমতার অপব্যবহার’- করে বিপুল সম্পদের মালিক হওয়ার অভিযোগ উঠেছে বেনজীর আহমেদের বিরুদ্ধে। এসব বিষয় নিয়ে লোকমুখে আলোচনা ছিল আরও অনেক আগে থেকে। অন্যদিকে সাবেক সেনাপ্রধান আজিজ আহমেদের বিরুদ্ধেও ক্ষমতার অপব্যবহারের নানা অভিযোগ ছিল দীর্ঘদিন থেকে। নিজের ক্ষমতার অপব্যবহার করে ভাইদের নানা সুবিধা দেয়ার অভিযোগ উঠেছে সাবেক সেনা প্রধানের বিরুদ্ধে। এনিয়ে কয়েক বছর আগে আন্তর্জাতিক একটি টেলিভিশন চ্যানেলে অনুসন্ধানী প্রতিবেদনও প্রচার হয়েছে। অনেকেই প্রশ্ন তুলছেন যে, অপরাধ চক্রে জড়িত থাকার অভিযোগের বিষয়টি ‘ওপেন-সিক্রেট’ হওয়ার পরেও একজন ব্যক্তি কীভাবে বার বার সংসদ সদস্য হিসেবে মনোনয়ন পেয়েছেন? আবার রাষ্ট্রের দু’টি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ পদে যারা ছিলেন তাদের বিরুদ্ধে যে ধরনের অভিযোগ আসছে তা সম্পাদনের সুযোগ পেলো কী করে? একের পর এক ঘটে যাওয়া এসব ঘটনা নিয়ে হতবাক খোদ আওয়ামী লীগের নেতারাও। ক্ষমতাসীন দলটির নেতাদের কেউ বলছেন ঘটনাগুলো চাঞ্চল্যকর, আবার কেউ বলছেন বিব্রতকর। তবে এ নিয়ে যাতে দলের ভেতর থেকে ভিন্ন ভিন্ন মত বের হয়ে না আসে, সেজন্য বেশ সতর্ক রয়েছেন সিনিয়র নেতারা। এজন্য প্রকাশ্যে বিষয়গুলো নিয়ে কথা বলা থেকে বিরত থাকছেন তারা। যা বলার দলের সাধারণ সম্পাদকই বলছেন। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের কয়েক দিন ধরে বলছেন, আজিজ-বেনজীর ইস্যুতে সরকার বিব্রত নয়। কারণ, সরকারের বিচার করার সৎ সাহস আছে। সরকার তাদের অপরাধ অস্বীকার করে পার পেয়ে যাওয়ার সুযোগ দেয়নি। দুর্নীতির ব্যাপারে সরকারপ্রধান আপসহীন। তবে দলীয়ভাবে এসব নিয়ে বাইরে তারা কথা না বললেও সংসদ অধিবেশনে এসব নিয়ে কথা বলার ইঙ্গিত দিয়েছেন আওয়ামী লীগ দলীয় এমপিরা।