দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে কম বয়সী নারীদেরকে আকর্ষণীয় বেতনে চায়নাতে চাকরি দেয়ার নাম করে পাচার এবং সেখানে নিয়ে গিয়ে তাদেরকে জোরপূর্বক পতিতাবৃত্তিতে বাধ্য করে আসছে একটি আন্তর্জাতিক মানব পাচার চক্র। আর পতিতাবৃত্তিতে রাজি না হলে চালানো হতো শারীরিক নির্যাতন। এমনই এক চক্রের মূল হোতা আব্বাসসহ ৪ জনকে গ্রেপ্তার করেছে র্যাব সদস্যরা। বুধবার সকালে রাজধানীর কাওরান বাজারে র্যাবের মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এমনটাই জানিয়েছেন র্যাব-৪ এর অধিনায়ক লে. কর্নেল মো. মাহবুব আলম।
তিনি বলেন, ‘আমাদের কাছে এমনই এক ঘটনার ভুক্তভোগী একটি অভিযোগ দেয় যে, সে ও তার খালাতো বোন একটি নারী পাচারকারী চক্রের শিকার হয়ে চায়নায় পাচার হয়েছিলেন। তার খালাতো বোন এখনও চায়নাতে বন্দী অবস্থায় আছেন এবং প্রতিনিয়ত শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়ে আসছেন। এই বিষয়ে আমাদের কাছে সহায়তা চাইলে আমরা ওই ঘটনাটি সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে ছায়াতদন্ত শুরু করি এবং একপর্যায়ে এই চক্রের মূলহোতাসহ ৪ জনকে গ্রেপ্তার করি। ওই ভুক্তভোগী পিরোজপুরে একটি বিউটি পার্লারে কাজ করতেন। কয়েক মাস আগে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকের মাধ্যমে ভুক্তভোগী ও তার খালাত বোনের সঙ্গে বাবু নামে একজনের পরিচয় হয়। বাবুর কাছে ঢাকায় একটি ভালো কাজের সন্ধান চান ভুক্তভোগী। বাবু তাদেরকে জানান, চায়নাতে আকর্ষণীয় বেতনে চাকরি আছে, বিশেষ করে যারা পার্লারের কাজ জানে এবং তাদেরকে চায়নায় আকর্ষণীয় বেতনে কাজের প্রস্তাব দেয়। তারা এই প্রস্তাবে রাজি হলে, তাদেরকে ঢাকায় নিয়ে আসেন এবং এই চক্রের মূলহোতা আব্বাসের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। আব্বাস তাদেরকে আশ্বাস দেন, চায়নাতে ভালো কাজ আছে এবং তাদেরকে সেখানে পাঠানো যাবে। তাদেরকে সেখানে ১ লাখ টাকা বেতনে চাকরি দেয়া হবে এবং সেখানে পৌঁছানোর পরপরই ১০ লাখ টাকা দেয়া হবে। এই প্রলোভন দেখানোর পর তাদেরকে পাসপোর্ট ও ভিসা করে সিলভি নামের এক মেয়ের মাধ্যমে চায়নাতে পাঠিয়ে দেন। পরবর্তীতে তারা চায়নায় যাওয়ার পর তাদেরকে বিউটি পার্লারে কাজ না দিয়ে দুই বোনকে আলাদা দু’টি বাসায় রেখে চক্রের সদস্যরা জোর করে পতিতাবৃত্তিতে বাধ্য করে।
এক পর্যায়ে ভুক্তভোগী নির্যাতন সহ্য না করতে পেরে অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং তাকে বিভিন্ন শর্তের ভিত্তিতে বাংলাদেশে ফেরত পাঠিয়ে দেয়। বাংলাদেশে ফিরে এসে আসামিদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন, তার যে বোন চায়নাতে আটক আছেন, তাকে ফিরিয়ে আনতে বলেন। তখন আসামি আব্বাস বোনকে উদ্ধার করে নিয়ে আসার আশ্বাস দিয়ে ভুক্তভোগীকে অনৈতিক কাজে বাধ্য করেন।’
তিনি বলেন, ‘পরবর্তীতে ভুক্তভোগী বুঝতে পারেন, সে মিথ্যা আশ্বাসে ক্রমাগত নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। তখন ভুক্তভোগী থানায় একটি মামলা রুজু করেন এবং র্যাবের কাছেও সহযোগিতা চান। আমাদের কাছে সহায়তা চাইলে আমরা ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের আইনের আওতায় আনতে নিবিড়ভাবে ছায়াতদন্ত শুরু করি। তদন্তের এক পর্যায়ে এই চক্রের মূলহোতাসহ অন্যান্য আসামিদের তথ্য প্রযুক্তির সহায়তায় অবস্থান শনাক্ত করি। পরে রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে অভিযান পরিচালনা করে তাদেরকে গ্রেপ্তার করা হয়। আসামিরা হলো-ফরিদপুরের আব্বাস মোল্লা (৩৬), ঢাকার আদাবরের জাহিদুল ইসলাম ওরফে বাবু (৩১), গোপালগঞ্জের মিনার সরদার (৩০) ও মোহাম্মদ রিপন শেখ (২৮)।
মো. মাহবুব আলম বলেন, ‘আসামিদের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, তারা প্রায় ৮ বছরের অধিক সময় ধরে এ রকম অসংখ্য মেয়েকে আকর্ষণীয় বেতনে চায়নাতে চাকরি দেয়ার নাম করে পাচার করে আসছেন। অনেক সময় তারা ভুক্তভোগীকে চীনা নাগরিকদের সঙ্গে বিয়ে এবং সে দেশের নাগরিকত্ব ও উন্নত জীবনের প্রলোভন দেখান। চক্রের সদস্যদের বিরুদ্ধে ইতোপূর্বে মানব পাচারের মামলা রয়েছে। গ্রেপ্তারকৃত আসামির বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ প্রক্রিয়াধীন।’