জোরপূর্বক পদত্যাগপত্রে সই করিয়ে মোহাম্মদ সাইফুল আলমের মালিকানাধীন এস আলম গ্রুপ ইসলামী ব্যাংক দখলে নেয় বলে জানিয়েছেন ব্যাংকটির সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আবদুল মান্নান। শুক্রবার ফোরাম ফর বাংলাদেশ স্টাডিজের আয়োজনে ‘ব্যাংকিং খাতে দখলদারিত্ব উচ্ছেদ’ শীর্ষক ওয়েবিনারে এ কথা বলেন তিনি। ওয়েবিনারে ফিন্যান্সিয়াল এক্সিলেন্সের চেয়ারম্যান মামুন রশীদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের অধ্যাপক রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর, মানারাত ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির অ্যাডজ্যাংক্ট প্রফেসর মো. মিজানুর রহমান আলোচনায় অংশ নেন। সঞ্চালনা করেন সাংবাদিক মনির হায়দার। এ সময় তিনি বলেন, বাংলাদেশের অর্থনীতির সবচেয়ে বড় কেলেঙ্কারি হলো এস আলমের ইসলামী ব্যাংক দখল।
২০১৭ সালের ৫ই জানুয়ারি ভোরে একটি গোয়েন্দা সংস্থার কয়েকজন কর্মকর্তা ইসলামী ব্যাংকের তৎকালীন এমডি আবদুল মান্নানকে তার বাসা থেকে তুলে নিয়ে যান। একইভাবে নিজ নিজ বাসা থেকে ব্যাংকটির চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যানকে তুলে নেয়া হয়। এরপর তাদের জোরপূর্বক পদত্যাগপত্রে সই করিয়ে ব্যাংকটি দখলে নেয় মোহাম্মদ সাইফুল আলমের মালিকানাধীন এস আলম গ্রুপ। পুরো প্রক্রিয়া বাস্তবায়ন করেন ওই গোয়েন্দা সংস্থাটির তৎকালীন কিছু শীর্ষ কর্মকর্তা উল্লেখ করে ব্যাংকটির সাবেক এমডি বলেন, ক্ষমতায় তখন শেখ হাসিনার সরকার। ওপর মহলের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তেই ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশকে ‘জামায়াতমুক্ত’ করার উদ্যোগ বাস্তবায়ন করে সংস্থাটি।
এই ধরনের একটি প্যাডে আমার পদত্যাগপত্র নেয়া হয়েছে।
তিনি বলেন, ওইদিন (৫ই জানুয়ারি, ২০১৭) অনেক রাত পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংকের স্যাররা অফিস করেছেন। তারা ওইদিনই ব্যাংকের মালিকানা পরিবর্তনের কাজটি দ্রুত সম্পন্ন করতে কাজ করেছেন। এগুলো কীভাবে হতে পারে একটি দেশের ব্যাংক খাতে। যে ব্যাংক খাত একটি দেশের অর্থনীতির প্রাণ।
এস আলম গ্রুপের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানিয়ে আবদুল মান্নান বলেন, পরের কয়েক বছর তাদের টেলিফোনে (এস আলম গ্রুপ) বাংলাদেশ ব্যাংক তাদের অনেক সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেছে। এসবের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া দরকার, যাতে ভবিষ্যতে এমনটা ঘটানোর কেউ সাহস না পায়।
দীর্ঘ সাড়ে সাত বছর পর দেশে ফিরেছেন জানিয়ে আবদুল মান্নান বলেন, বিদেশে থাকার সময় দেশ থেকে সাংবাদিকদের কেউ কেউ যোগাযোগ করলেও আমি কথা বলিনি। কারণ, আমি নিরাপদ বোধ করিনি। আতঙ্কের মধ্যে থেকেছি। আবার বাংলাদেশে এসে নিঃশ্বাস নিতে পারবো বলে মনে করিনি। তিনি বলেন, আমি এখন মনে করি, কথা বলার স্বাধীনতা পেয়েছি। তবে সেই ভয় কাটতে বোধহয় সময় লাগবে। মুক্ত বাতাসে নিঃশ্বাস নিতে বোধহয় আমার আরও সময় লাগবে।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)’র সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ব্যাংক ও আর্থিক খাতে প্রতারণা ও দুর্বৃত্তায়নের মূল কারণ হিসেবে নষ্ট ও পচা রাজনীতি দায়ী। ইসলামী ব্যাংক দখলের পেছনে রাজনৈতিক কারণ ও রাজনীতিকদের নির্দেশ ছিল। ইসলামী ব্যাংক দখলে সাবেক রাষ্ট্রপ্রধানের সরাসরি নির্দেশনা ছিল উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, সাবেক রাষ্ট্রপ্রধান তাদের প্রতিনিধি হিসেবে এস আলম গ্রুপকে ইসলামী ব্যাংক দখল করতে সরাসরি নির্দেশনা দেয়।
ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে ২০১৪ সালে লোক দেখানো নির্বাচন করে বিদায়ী সরকার। আর সুষ্ঠু নির্বাচন না হওয়ার কারণেই তারা পরবর্তী সময়ে দখলদারিতে গেছে উল্লেখ করেন বদিউল আলম মজুমদার। তিনি বলেন, বিদায়ী সরকার ক্রোনি গোষ্ঠী (স্বজনতোষী পুঁজিপতি) সৃষ্টি করে। তারাই আর্থিক প্রতিষ্ঠান দখল করেছে। তিনি বলেন, রাজনীতি ঠিক না করে ও সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে সঠিক নেতৃত্ব না আনা গেলে পরিস্থিতির উন্নতি হবে না। অন্যথায় সমস্যার সমাধান হলেও তা টেকসই হবে না।
ফিন্যান্সিয়াল এক্সিলেন্সের চেয়ারম্যান মামুন রশীদ বলেন, বর্তমান সরকার তিনটি বিষয় অগ্রাধিকার দিয়েছেন। এরমধ্যে খেলাপি ঋণ উত্তোলনের চেষ্ট করবেন। পাচার হওয়া টাকা ফেরত আনা। আর সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা। তিনি বলেন, ইসলামী ব্যাংক ভালো ব্যাংক ছিল। কিন্তু সেই ব্যাংক থেকে এস আলম একাই ৫০ হাজার কোটি টাকা তুলে নিয়েছে। আর্থিক খাতে তৈরি হয়েছে এস আলম মডেল।
অধ্যাপক রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর গণমাধ্যমকে ধন্যবাদ দিয়ে বলেন, শত বাধার মধ্যেও আর্থিক খাতের কেলেঙ্কারি প্রকাশ করেছেন। ব্যাংকিং খাতে এত পরিমাণ মন্দ ঋণ যে কেউ ব্যাংকে অর্থ রাখলে তার অর্থ খেয়ানত হয়ে যাবে।