আতিক উল্লাহ আল মাসউদ
মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব। এই শ্রেষ্ঠত্বের অন্যতম মহত্ব হলো, আল্লাহ তাআলা মানুষকে শ্রমনির্ভর করে সৃষ্টি করেছেন। প্রত্যেক মানুষ স্থান, কাল ও পাত্র ভেদে শ্রমজীবী। শ্রমজীবী হওয়া দাসত্বের নয় বরং মনুষ্যত্বের গুণ। মানব সৃষ্টির গুণাগুণ বর্ণনা দিতে গিয়ে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘নিশ্চয়ই আমি মানুষকে শ্রমনির্ভর রূপে সৃষ্টি করেছি।’ (সুরা বালাদ: ০৪)
শ্রম বিনিময় করে রিজিক তালাশ করার মধ্যে মানুষ্য জাতির ভারসাম্য ফুটে ওঠে। এর বিপরীতে রয়েছে অলসতা ও অন্যের মুখাপেক্ষিতা। অলসতা মূলত দরিদ্রতার প্রথম ফটক। যদিও আমাদের জনজীবন দিন দিন অলসতা ও মুখাপেক্ষীর দিকে ধাবিত হচ্ছে। আমরা যদি এই মাহেন্দ্রক্ষণে দাঁড়িয়ে বর্তমান অর্থনীতির দিকে দৃষ্টি রাখি, তাহলে দেখতে পাই চলমান অর্থনীতিকে গতিশীল করতে হলে সবাইকে শ্রমনির্ভর উপার্জনের দিকে নজর দিতে হবে।
ইসলামি অর্থনীতি শ্রমনির্ভর কর্মদক্ষতার ওপরে দাঁড়িয়ে আছে। আল্লাহ তাআলা যতজন নবি ও রাসুলকে দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন, সবাইকে শ্রমিকের গুরুদায়িত্ব প্রদান করেছেন। এমন কোনো নবি নেই যারা শ্রমজীবী ছিলেন না। হজরত আদম (আ.), হজরত শিস (আ.) ও হজরত লুত (আ.) কৃষিকাজ করতেন। হজরত নূহ (আ.) ও হজরত জাকারিয়া (আ.) কাঠের ফার্ণিচার তৈরি করতেন। হজরত দাউদ (আ.) লৌহজাত দ্রব্য তৈরি করতেন। হজরত ইলিয়াস (আ.) সুতা দিয়ে কাপড় বুনতেন। হজরত ইউনুস (আ.) মাছ বিক্রেতা ছিলেন। হজরত ইব্রাহিম (আ.), হজরত ইয়াকুব (আ.), হজরত হুদ (আ.), হজরত সালেহ (আ.) ও হজরত মুহম্মদ (সা.) ব্যবসা-বাণিজ্য করতেন।
ফতহুল বারী ২০৭১ নাম্বার হাদিসের ব্যাখ্যা হচ্ছে, শ্রমিককে ইসলাম অত্যন্ত সম্মানের চোখে দেখে। কোনো পেশা বা শ্রমকে ছোট করে দেখার সুযোগ ইসলামে নেই। পরিশ্রম করে জীবিকা নির্বাহ করার মাঝেই সম্মান আছে। এমনকি রাসুল (সা.) বকরি চরানোর মতো কঠিন পরিশ্রম করেই জীবিকা নির্বাহ করেছেন। তিনি বলেন, ‘আল্লাহ দুনিয়াতে এমন কোন নবি পাঠাননি, যিনি বকরি চরাননি।’ তখন সাহাবাগণ প্রশ্ন করলেন, ‘আপনিও কি বকরি চরিয়েছেন?’ রাসুল (সা.) বললেন, ‘আমিও মজুরির বিনিময়ে মক্কাবাসীদের বকরি চরাতাম।’ (সহিহ বুখারি: ১৩৪০)
প্রত্যেক জাতির লোকেরা পরিশ্রম করে জীবিকা নির্বাহ করেছেন। শরীরের ঘাম নিঃসরণ করে নিজের যোগ্যতার আলোকে আর্থসামাজিকতায় ভূমিকা রাখার মধ্যে কল্যাণ আছে। তবে আমাদের কার্যক্ষমতায় সীমাবদ্ধতা থাকার কারণে আমাদের শ্রমিক নিয়োগ দিতে হয়। এতে মালিক ও শ্রমিক উভয়ের উপকার হয়ে থাকে। ইসলাম এখানে সৌহার্দ রক্ষা করার জন্য বিশেষ তাগিদও দিয়েছে। কারণ মালিক যেন নিজের প্রভুত্ব জাহির করতে না পারে। শ্রমিক যেন কাজে অনিয়ম ও দুর্নীতি করতে না পারে।
আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আমি তাদের মধ্যে তাদের জীবিকা বণ্টন করেছি পার্থিব জীবনে এবং একের ওপর অন্যকে শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছি। যাতে তারা একে অপরকে সেবক হিসেবে গ্রহণ করে। আর তারা যা সঞ্চয় করে, আপনার প্রভুর রহমত তদপেক্ষা উত্তম।’ (সুরা আয যুখরূফ: ৩২)
মালিক কখনোই শ্রমিককে কর্কশ ও অকথ্যভাবে নাজেহাল করতে পারবে না। শ্রমিক যেভাবে মালিকের সেবা প্রদান করবে, মালিক তেমনি করে শ্রমিকের সঙ্গে উত্তম আচরণ করবে। এ ব্যাপারে রাসুলের (সা.) সর্বশেষ উপদেশের মধ্যে পাওয়া যায়। তিনি বলেন, ‘তোমরা অধীনস্থদের ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় কর।’ (আবু দাউদ: ৫১৫৬)
শ্রমিকের সঙ্গে অশোভন আচরণ করলে কিয়ামতের দিন তাকে আল্লাহর দরবারে জবাব দিতে হবে। রাসুল (সা.) বলেন, ‘সাবধান, তোমরা সবাই দায়িত্বশীল। তোমাদের সবাইকেই তার দায়িত্বের ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করা হবে।’ (বুখারি: ৮৯৩) শ্রমিক নিয়োগ ও আচরণের বিভিন্ন দিক নিয়ে হজরত মুহম্মদ (সা.) কড়া নির্দেশ দিয়েছেন। পারিশ্রমিক নির্ধারণ করে শ্রমিক নিয়োগ দিতে হবে। যাতে পরে কারো মনে আঘাত ও বিষণ্নতা দেখা না যায়। রাসুল (সা.) মজুরি নির্ধারণ না করে শ্রমিক নিয়োগ দিতে নিষেধ করেছেন। (মুসানাদে আহমাদ: ১১৫৬৫)
চুক্তিনির্ভর নিয়োগের মাধ্যমে পরস্পর ভাতৃত্ব গড়ে উঠবে। এতে রেষারেষি তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে না। কোনো প্রকার গড়িমসি সৃষ্টি হবে না। কারণ ধনি মানুষের তালবাহানাও জুলুম। (সুনানে তিরমিযি: ১৩০৯) শুধু চুক্তি করলে শ্রমিকের হক আদায় হবে না। তার প্রাপ্য পূর্ণমাত্রায় পরিশোধ করতে হবে। রাসুল (সা.) বলেন, ‘শ্রমিকের দেহের ঘাম শুকিয়ে যাওয়ার পূর্বে তোমরা তার মজুরি দিয়ে দাও।’ (ইবনে মাজাহ: ২৪৪৩)
শ্রমিকের দায়িত্ব হলো ভালোভাবে কাজ করা আর মালিকের দায়িত্ব হলো কাজ আদায় হওয়া মাত্র মজুরি আদায় করা। না হয় কঠিন শাস্তি ভোগ করতে হবে। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘আল্লাহ তায়ালা বলেন, কিয়ামতের দিন আমি তিন ব্যক্তির বিরুদ্ধে বাদী হবো। তাদের একজন হলো ওই ব্যক্তি, যে শ্রমিক নিয়োগ করার পর তার থেকে পুরো কাজ আদায় করে নেয়, কিন্তু তার পারিশ্রমিক দেয় না। (বুখারি)
যে মালিকের বিপক্ষে আল্লাহ তাআলা বাদী হবেন, তার জন্য মুক্তির আশা নেই। যেমন অন্য এক হাদিসে রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘অধিনস্থদের সঙ্গে দুর্ব্যবহারকারী মনিব জান্নাতে প্রবেশ করবে না।’ ইবনে মাজাহ)
শ্রমিকরা আমানতের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করার মাধ্যমে আমাদের সচ্ছলতা আসে। কাজেই তাদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার কখনোই কাম্য নয়। আমাদের উচিত, শ্রমিকের যথাযথ প্রাপ্য ও হক আদায় করা। তাদের জীবনের প্রতি দৃষ্টি রাখাও মালিক পক্ষের দায়িত্বের অংশ। তার বিপদাপদে সঙ্গে থাকা মালিকের নৈতিক দায়িত্ব।
পরিশেষে বলতে চাই, শ্রমিকরাই অর্থনীতির চাকা সচল রাখার সাহসী সৈনিক। তাদের নিঃসৃত ঘাম আমাদের জন্য নিয়ামত। কাজেই তাদের সঙ্গে উত্তম আচরণ করা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব।