“রাজা” ক*ন*ড*ম আর “হিরো” ক*ন*ড*ম ছিলো বেশি প্রচলিত। চায়ের দোকান থেকেও কিনতাম। প্রায় কোল বালিশ সাইযের বানিয়ে ফেলতাম ফুলিয়ে। বড়রা এগুলা পচা জিনিস,বাজে তেল দিয়ে বানায় এই সেই নানা কথা বলতো। কিন্তু এই ক*ন*ড*ম*কে বেলুন বানিয়ে খেলার কারণেই চায়ের দোকানীরা বিক্রি করতো খেলনা হিসাবে।
শুক্রবারটা ছিলো একটা ঈদের দিনের মতোন। সিনেমা হতো দুপুর আড়াইটা থেকে বিকাল পর্যন্ত। ম্যাগগেইভার আর আলিফ লায়লা চলতো সকাল দিকে।
একসাথে সিনেমা দেখার আলাদা মজা ছিলো। বড়রা খাটে বা সোফায় বসতো আমরা নিচে বসতাম। আঙুল দিয়ে বিজ্ঞাপণ গুনতাম। প্রায় বারোটা বিজ্ঞাপণ দেখানোর পরই সিনেমা শুরু হতো।
রুবেল, দিতি, জসীম, সাবানা, ববিতা, মৌসুমি, রাজ্জাক ছিল নায়ক নায়িকা। এদের কেউ নেই মানে সিনেমা পানসে। রাজীব, রানি, শরীফ, মিশা, জাম্বু ভিলেন থাকার কারণে কতো গালিই যে খেত তার হিসেব নেই। নায়ক মার খেলে আমাদের আফসোস হত, অসহায় ববিতার কান্নায় চোখে পানি চলে আসতো।
বিকেলটা ছিল অনেক লম্বা,শেষ হইতো না। তখন খেলতাম ইচিং বিচিং, কুতকুত, বউছি, ফুলের টোকা, বরফ পানি, ছোঁয়াছুঁয়ি, সাতচারা, ডাংগুলি, রুমাল চোর,গোর্লাচুট আরও কী কী মনেও নেই। খুব ছোটরা খেলার বায়না ধরলে তাদেরকে “দুধভাত” হিসেবে খেলায় নিতাম, তবুও ছোট বলে তাকে বঞ্চিত করতাম না।
ঝগড়া হলে তাহলে কাইন আঙুলে আড়ি নিতাম, দু দিন কথা বলতাম না। তারপর আবার আনুষ্ঠানিক ভাবে দুই আঙুলে ” ভাব” নিতাম।
তখন আবার রক্তের বান্ধবীর প্রচলন ছিল। কারও হাত কাটলে ছুটে যেতাম রক্তের সই পাতাতে। আমার কাটা আঙুলের সাথে ভাল আঙুল মিলিয়ে হতাম “রক্তের বান্ধবী, কোনদিন এই বন্ধুত্ব যাবেনা”। কই গেল আমার সেই বন্ধু গুলা।
মারবেল দিয়ে বিড়িং খেলা হত। দামি খেলনা ছিলো রবারকোপ আর পিস্তল। টাকাওয়ালা বাবার ছেলেরা খেলত ব্যাটারির পুতুল দিয়ে। পুতুলের সুইচ অন করলেই বাজত ‘চল ছাইয়া ছাইয়া’ গান। বেশিরভাগ মেয়েদের হাড়িপাতিল থাকতো অনেকগুলা। সকাল হলে ভাত রান্না করতো আবার।
সন্ধ্যা হলেই শুরু হত যন্ত্রণা। বই খাতা খুলে পড়তে বসা লাগবে। সবার আগে পড়তাম সমাজ। হারিকেনের দিন শেষ হয়ে আসলো কারেন্টের দুনিয়ায়। চার্জার লাইটগুলা চার্জ দেয়া লাগতো,কখন কারেন্ট যাবে বলা যায় না,বাড়ির কাজও হবে না। অংক করতে বিরক্তি থেকে মুক্তি পেতে দোয়া করতাম, “আল্লাহ, কারেন্ট যা”।
যেই কারেন্ট যেত অমনি সবাই একসাথে চিৎকার করে বেড়িয়ে আসতাম ঘর থেকে। শুরু হয় নতুন খেলা, ‘চোখ পলান্তিস’ নাইলে ‘বরফ পানি’। বড়রা বিরক্ত হয়ে যেতো চিল্লাচিল্লিতে।
খেলার সময় নিয়ম ছিল, যার ব্যাট সে আগে ব্যাটিং করবে। যার৷ যার বল সে একাই তিন ওভার বোলিং করবে। যার র্যাকেট সে কখনো বেট্টাস হবেনা। আজব নিয়ম ছিলো অনেক,বাউন্ডারির বাইরে বল গেলে আউট।
প্রতিদিন কটকটি ওয়ালা আসত, কেউ ভাঙাচোরার বদলে দিতো কটকটি সনপাপড়ি নইলে কুলফি। উফ সেউ কুলফিটা আর কোনদিন পাইনাই, সেকারিন মিশানো আইসক্রিম। খেলেই জিভ ঠোট লাল হয়ে যেত। সেই লাল ঠোট নিয়ে আমাদের কি গর্ব, আজো চোখে ভাসে। নারিকেল পাতা দিয়ে চশমা আর হাত ঘড়ি বানিয়ে দিতাম ছোটদের। কত কাগজের নৌকা দিঘিতে ভাসিয়েছি। সুপারি গাছের শুকনো
খৈলে বসিয়ে কত টেনেছি বন্ধুদের। কখনো লাঠির আগায় বোতলের মুখ পেরেক দিয়ে লাগিয়ে গাড়ি বানিয়ে খেলেছি,কখনো বা সাইকেলের টায়ার পিটিয়ে এক গ্রাম থেকে আরেক গ্রাম ভ্রমণ করেছি।
ঈদ আসলে আমরা ঈদ কার্ড কিনতাম। “মিষ্টি মিষ্টি হাসিতে, দাওয়াত দিলাম আসিতে”- এমন ছন্দ লিখে বন্ধু বান্ধবদের দাওয়াত দিতাম। সেই সময় সব চাইতে দামী জরি ওয়ালা ঈদ কার্ড যেটা ছিল সেটা খুললে ভেতর থেকে অবিশ্বাস্য ভাবে মিউজিক বাজত। ঈদের জামা ঈদের দিন ছাড়া কাউকে দেখাতাম না, পুরানো হয়ে যাবে ভেবে। জামা লুকিয়ে রাখা ছিল সেসময় আমাদের বড় চ্যালেঞ্জ।
চাঁদ রাতে হাতে মেহদী দিতাম,বড় আপুরা নামের প্রথম অক্ষর লিখে দিতো মেহদী দিয়ে। সকালে কার কার কাছে গেলে বেশি টাকা পাওয়া যাবে হিসেব করতাম, টাকা দিয়ে পিস্তল ছাড়া আর কী কেনা যায় ভাবতাম। সকাল হওয়ার আগেই মসজিদের মাইকে গজল গাইতো কারা যেনো। আর বারবার ঈদ মোবারক জানাইতো। আফসোস লাগতো রমজানের মতো একটা বড় ছুটি শেষ, আবার আনন্দ লাগতো সবাই বাড়ি আসবে টাকা জমবে।
কী সব সোনালী দিন ছিল আমার। আজকের অলস সন্ধ্যা এইসব ভেবেই কেটে গেল। এই প্রযুক্তির যুগে আর ইচ্ছা নেই ঈদ কার্ড কেনার, ভয়েস ম্যাসেজে ঈদ মোবারক জানাই দেই। সময়ের লগে মানুষও বদলে গেলো, বদলে গেলো সবার ইচ্ছা অভ্যাস সব। কিন্তু শৈশবের মায়ামাখা সেইসব স্মৃতি কল্পনা করতেও আনন্দ লাগে। একলাই হাসি, ভাবি যে এসব তো কুড়ি বছর আগের গল্পও না,এই এক দশকও আগের না,এতো অতীত লাগে কেনো! এতো দ্রুত সব বদলে গেলো কেনো…..
(স্মৃতিচারক – শিক্ষক, সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মী)