1. admin@mannanpresstv.com : admin :
সত্যজিৎ রায়ের নায়িকা ববিতা - মান্নান প্রেস টিভি
রবিবার, ১৮ মে ২০২৫, ০৩:২৩ পূর্বাহ্ন

সত্যজিৎ রায়ের নায়িকা ববিতা

খান আখতার হোসেন:
  • Update Time : মঙ্গলবার, ২৮ নভেম্বর, ২০২৩
  • ১৭৮ Time View
খান আখতার হোসেন:  প্রায় দশ বছর চিত্র সাংবাদিক হিসেবে সাংস্কৃতিক অঙ্গনে যুক্ত ছিলাম। কাজ করতাম ফিল্ম পাড়ায়, শুটিং স্পটে, নাটক পাড়ায়, শিল্পকলা একাডেমীতে, বেতার-টেলিভিশনে। যেখানে সাংস্কৃতিক চর্চা, সেখানেই আমি। ১৯৭৯ সালে এফডিসির শুটিং ফ্লোরে প্রথম দেখলাম ববিতাকে। সেদিন তিনি নায়ক রাজ্জাকের সাথে “কালো গোলাপ” ছবির শুটিং করছিলেন। একজন ভক্ত হিসেবে সেদিন আমি দূর থেকে ববিতার অভিনয় দেখেছিলাম। এটাই ছিল আমার জীবনে প্রথম এফডিসিতে প্রবেশ ও রূপালি জগতের অভিনেতা অভিনেত্রীদের দেখা। সেদিন পরিচালকের কথায় প্রোডাকশন ম্যানেজার বহিরাগত হিসেবে আমাকে শুটিং স্পট থেকে বের করে দিয়েছিলেন।
ফ্লোর থেকে বের হতে হতে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম- এই শুটিং স্পটে মাথা উঁচু করে একদিন আমি ঢুকবো। ভর্তি হলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। কিনলাম ইয়াসিকা ক্যামেরা। দৈনিক দেশ বাংলার নির্বাহী সম্পাদক আমিনুর রহমান আমাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রিপোর্টার হিসেবে দৈনিক দেশ বাংলায় নিয়োগ করিয়ে দিলেন। শুরু হলো সাংবাদিকতা জীবন। শুরুতেই আমি সাক্ষাৎকার নিলাম প্রখ্যাত সুরকার সত্য সাহা, চলচ্চিত্র প্রযোজক রমলা সাহা, মাস্টার সুমন, চলচ্চিত্র পরিচালক সিবি জামান, চলচ্চিত্র পরিচালক শিল্পী চক্রবর্তীসহ অনেক শিল্পী ও কলাকুশলীদের। নিয়মিত ছাপা হল দৈনিক দেশ বাংলায়। শুরু হলো এক নতুন জীবন। এভাবেই একদিন অবারিত হয়ে গেল এফডিসি, টেলিভিশন, রেডিও। এভাবেই আমি চিত্র সাংবাদিক হিসেবে একদিন মাথা উঁচু করে এফডিসিতে ঢুকলাম।
কাজের ফাঁকে ফাঁকে আমি পরিচালক সমিতি, শিল্পী সমিতি, প্রযোজক সমিতিসহ সকল সমিতি অফিসে গিয়ে সময় কাটাতাম। যে ফ্লোর থেকে একদিন আমাকে বের করে দেয়া হয়েছিল, সেই ফ্লোরে ঢুকলে চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্ঠরা আমাকে চেয়ার দিতো, নাস্তা দিতো, গল্প করতো, ছবি তোলার সময় দিতো- অপূর্ব পরিবর্তন। সাংবাদিকদের সকলেই ভালবাসেন। যা আমার জীবনে অনন্য হয়ে ওঠে।
একদিন বিকেলে দেখি শিল্পী সমিতির কক্ষে ববিতা একা বসে আছেন। তার সামনের সোপায় বসলাম। তিনি টেলিফোনটি নিয়ে আঙ্গুল দিয়ে শব্দ করে এক সময় থামলেন, ওপার থেকে কেউ যেন ফোন ধরল। তিনি কথা বললেন। আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম- টেলিফোনতো তালা দেওয়া। কিভাবে আপনি ফোন করলেন?
তিনি বললেন, শুধু সাংবাদিকতা করলেই হলো। সবদিকেই নজর দিতে হয় বুঝলেন? এভাবে ঠক্ ঠক্ করে নম্বরে যাওয়া যায়। একটি টক্কর দিবেন, ও পাশে ১ উঠবে। দুইটি টক্কর দিবেন, ও পাশে ২ উঠবে। এভাবে টক্কর দিয়ে নাম্বার তোলার পর একসময় ওপাশে রিং হবে। ওপাশ থেকে আকাঙ্ক্ষিত ব্যক্তি সেই ফোন ধরবে। তালা মারা থাকলেও ল্যান্ড ফোনে যে ফোন করা যায় সেটা আপনাকে শিখিয়ে দিলাম কিন্তু। এভাবেই ববিতার কাছাকাছি আসার সুজোগ হয়। তাঁর আরও কাছে চলে আসি সাপ্তাহিক সিনেমার নির্বাহী সম্পাদক চলচ্চিত্র পরিচালক আখতারুজ্জামানের “পোকামাকড়ের ঘর বসতি” ছবির শুটিংয়ের সময়। আখতারুজ্জামানের সহকারী হিসেবে “একাই একশো” ছবিতে কাজ করার পর “পোকামাকড়ের ঘরবসতি” ছবিটিতো তাঁর সাথে ছিলাম। ববিতা আলমগীরের অভিনয়, জীবনযাপন, চালচলন, কথাবার্তার ধরন, ব্যক্তিত্ব সবকিছ অতি কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয় আমার।
ববিতার পুরো নাম ফরিদা আক্তার পপি। বাগেরহাট নানা বাড়িতে ১৯৫৩ সালে ৩০ শে জুলাই জন্মগ্রহণ করেন। তার পৈতৃক বাড়ি যশোর। বড় বোন সুচন্দার স্বামী প্রখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক জহির রায়হানের হাত ধরে যখন তিনি চলচ্চিত্রে আসেন তখন তিনি ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়েন। কবিতা রুপালি পর্দায় প্রথম পা রাখেন “সংসার” ছবির মাধ্যমে। এ ছবিতে তিনি রাজ্জাক ও সুচন্দার মেয়ের চরিত্রে অভিনয় করেন। সংসার ছবিতে ববিতার নাম ছিল সুবর্ণা। কিন্তু তাঁর ভগ্নিপতি জহির রায়হানের “জ্বলতে সুরুজ কি নীচে” ছবিতে অভিনয়ের সময় নাম পাল্টে যায়। সুবর্ণার পরিবর্তে তাঁর নাম হয়ে যায় ববিতা। নায়িকা হিসেবে ১৯৬৯ সালে ববিতার প্রথম মুক্তিপ্রাপ্ত ছবি “শেষ পর্যন্ত”। মহান মুক্তিযুদ্ধের পর নতুন রাষ্ট্র বাংলাদেশের বিভিন্ন ছবিতে তিনি ব্যস্ত হয়ে পড়েন। কিন্তু ভুলতে পারেন না অগ্নিপতি জহির রায়হানকে। যিনি 1971 সালের ৩০ শে জানুয়ারি নিখোঁজ হয়েছিলেন। আলোক ঝলমলে চলচ্চিত্র অঙ্গনে জহির রায়হান নেই এটা কিভাবে মানবেন তিনি? তবুও জীবনের তাগিদে চলতে হয়। ববিতা ব্যস্ত হয়ে ওঠেন চলচ্চিত্র অঙ্গনে। ১৯৭৩ সালে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন চলচ্চিত্র পরিচাল সত্যজিৎ রায়ের “অশনী সংকেত” ছবিতে অনঙ্গ বউ চরিত্রে তিনি অভিনয়ের সুযোগ পান। “অশনী সংকেত” ছবিটি মুক্তি পেতেই আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ববিতার অভিনয়ের সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। সত্যজিৎ রায়ের ছবির নায়িকা হিসেবে ববিতার কদর বেড়ে যায়। তিনি সৃজনশীল, বাস্তবধর্মী জীবন ভিত্তিক ছবির প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠেন তিনি। জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার একের পর এক তার ভাগ্যে যুক্ত হতে থাকে। ১৯৭৫ সালে “বাদী থেকে বেগম”, ১৯৭৬ সালে “নয়ন মনি”, ১৯৭৭ সালে “বসুন্ধরা”, ১৯৮৫ সালে “রামের সুমতি”, ১৯৯৬ সালে “পোকামাকড়ের ঘর বসতি”তে অনবদ্য অভিনয়ের জন্য তিনি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করেন। ববিতার অনবদ্য অভিনয় জুরি বোর্ডের বিচারকদের অবাক করে দেয়। ববিতা যখন যে চরিত্রে অভিনয় করেছেন তার সাথে মিশে গেছেন তিনি। কখনও গ্রাম্য বধূ, কখনও শহুরের মডার্ন কন্যা, কখনো প্রতিবাদী নারী চরিত্র। সব চরিত্রে ববিতা স্বার্থক।
ববিতা অভিনীত আমজাদ হোসেনের চলচ্চিত্র “নয়নমনি” “গোলাপী এখন ট্রেনে” “জন্ম থেকে জ্বলছি”, “কসাই” ‘সুন্দরী” বাংলাদেশের দর্শক মনে রাখবে চিরদিন। মূলধারার এসব ছবিগুলো ব্যবসা সফল ছবি। শুধু যে মারদাঙ্গা ছবি ব্যবসা করে তা নয়। সামাজিক মূলধারার ছবিও ব্যবসা করতে পারে তা আমজাদ হোসেন পরিচালিত এসব ছবি দেখলে বোঝা যায়।
ববিতা প্রযোজনার জন্যও জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করেন। ১৯৭৩ সালে “অশনী সংকেত” চলচ্চিত্রে অভিনয়ের জন্য ভারতে বাংলা চলচ্চিত্র সাংবাদিক সমিতি প্রদত্ত পুরস্কার অর্জন করেন। বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সাংবাদিক সমিতি থেকে চারবার, “নন্দিনী” চলচ্চিত্রের জন্য পাকিস্তানের জাতীয় চলচ্চিত্র এবং ১৯৭৯ সালে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সমালোচক পুরস্কার অর্জন করেন। বাংলাদেশ সরকার ২০১৬ সালে তাকে চলচ্চিত্রের আজীবন সম্মাননা প্রদান করে।
এই প্রখ্যাত আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন অভিনেত্রী ববিতা ২০১২ সাল থেকে জাতিসংঘের বিশেষ সংস্থা ডিসট্রেস চিলড্রেন এন্ড ইনফ্যান্টস ইন্টারন্যাশনালের শুভেচ্ছা দূত হিসেবে যুক্ত ছিলেন। তাঁর একমাত্র সন্তান অনিক কানাডায় ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং এ মাস্টার্স শেষ করে সেখানে একটি প্রতিষ্ঠানে কনসালটেন্ট হিসেবে কাজ করছেন।
ববিতা এখন দেশ-বিদেশ করে ঘুরে বেড়ালেও তিনি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রকে উপস্থাপন করেন বলিষ্ঠভাবে।

Please Share This Post in Your Social Media

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More News Of This Category

Categories

© All rights reserved © 2022 mannanpresstv.com
Theme Customized BY WooHostBD