খান আখতার হোসেন: ১৯ ৮৭ সাল। তখন বন্যায় ডুবে গেছে ঢাকার নিম্নাঞ্চল। প্রতিদিন ঢাকা থেকে বন্যার্তদের সাহায্য করতে ছুটে যান বিত্তশালী মানুষেরা। খেলোয়াড়, শিল্পী, সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো বন্যার্তদের সাহায্যার্থে ছুটে যেতেন। একদিন ভোরবেলা এফডিসিতে হাজির হলাম। শাবানা গাড়ি নিয়ে সেখানেই আসেন। আমরা কয়েকজন সাংবাদিক, অভিনেতা তাঁর সাথে যুক্ত হলাম। গেলাম সোনারগাঁও বন্যার্তদের মাঝে। নৌকা করে পানি ভেঙ্গে ভেঙ্গে শাবানার সাথে আমরা চিত্র সাংবাদিকরা সাথে গেলাম। শাবানা নিজে হাতে বন্যার্তদের মাঝে কাপড় দিলেন, শুকনা খাবার দিলেন, সান্তনা দিলেন। একের পর এক ছবি তুললাম। পরদিন দৈনিক বাংলার বাণীসহ বিভিন্ন দৈনিকে ছাপা হলো- বন্যার্তদের মাঝে সাহায্য দিচ্ছেন চিত্রনায়িকা শাবানা।
হোটেল শেরাটন। কনফারেন্স রুমে আয়োজন করা হয়েছে সংবাদ সম্মেলন। বিদেশ থেকে শাবানা পেয়েছেন আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র পুরস্কার। এই পুরস্কার উপলক্ষে সাংবাদিক সম্মেলন। আমি সাপ্তাহিক তিলোত্তমার সাংবাদিক পলিকে নিয়ে সময় মত ঢুকলাম। দেখি আমার আগেই চিত্রালীর নরেশ ভূঁইয়া, পূর্বানীর রফিকুজ্জামান, ফটোগ্রাফার বেলাল, আনন্দ বিচিত্রার রফিকুর রহমান, দৈনিক আজাদের মাইনুল হক ভূঁইয়া, দৈনিক রুপালীর ফরিদ বাশার, ছায়াছন্দের গোলাম কিবরিয়া, সাপ্তাহিক সিনেমার শামীম আলম দীপেন, পাক্ষিক প্রিয়জনের আব্দুর রহমান, সাপ্তাহিক বিচিত্রার চিন্ময় মুৎসুদ্দিসহ অনেকেই এসেছেন। রানীর বেশে শাবানা এলেন এবং আমাদের সামনে তুলে ধরলেন তার পুরস্কার।
গুলশানের স্বামী ওয়াহিদ সাদেকের বাড়ি। শাবানা জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পাওয়ায় সাংবাদিকদের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে ডিনারের জন্য। সাংবাদিক হিসেবে আমি সেখানে গেলাম। শাবানা পারিবারিক পরিবেশে আমাদের সাথে ঘন্টার পর ঘন্টা গল্প করলেন, আড্ডা দিলেন, বললেন তার অভিনয় জীবনের কথা। নিজ হাতে তুলে দিলেন সকলের মাঝে খাবার। ওয়াহিদ সাদিক ও শাবানা ঘুরে ঘুরে সকল সাংবাদিককে আপ্যায়ন করলেন, আড্ডা দিলেন। আমরা যে কত আপনজন তা এ ধরনের অনুষ্ঠান হলে বোঝা যায়। একে অপরের সুখে-দুঃখে এই চলচ্চিত্রাঙ্গনে আমরা এক হয়ে থাকি। এযেনো আমাদের এক সংসার।
১৯৮৫ সালে শাবানার সাথে আমার যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল চট্টগ্রাম জেলার রাউজান উপজেলার পশ্চিম ডাবুয়া গ্রামে- যেখানে তিনি ৫৩ সালের ৫ জুন জন্মগ্রহণ করেন। তিনি মধ্য সর্ত্তা রামসেবক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৫ম শ্রেণী পর্যন্ত পড়েছেন। সে স্কুলটিও তিনি আমাদের দেখিয়েছিলেন। তাঁর বাবার নাম পয়েক চৌধুরী, মায়ের নাম ফজিলাতুন্নেছা ও স্বামীর নাম ওয়াহিদ সাদিক। “নতুন সুর” ছবিতে শিশু শিল্পী হিসেবে অভিনয় শুরু করেন। তখন তার নাম ছিল আফরোজা সুলতানা রত্না। বিশিষ্ট চলচ্চিত্রকার এহতেশাম ছিলেন সম্পর্কে চাচা। তাঁর হাত ধরে চলচ্চিত্রে প্রবেশ করেন শাবানা। ১৯৬৭ সালে “চকোরি” ছবিতে তিনি নায়িকা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। তাঁর বিপরীতে নায়ক ছিলেন নাদিম। এই ছবিতেই এহতেসাম তাঁর নাম দেন শাবানা। অভিনয় জীবনে শাবানা ২৯৯টি ছবিতে অভিনয় করেছেন। যার ১৩০ টি ছবির নায়ক ছিলেন আলমগীর। দর্শকদের কাছে আলমগীর-শাবানা জুঁটি দর্কশপ্রিয় হয়। আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তার নায়িকা শাবানা দর্শকের কাছে ‘বিউটি কুইন’ হয়ে ওঠেন।
১৯৭৩ সালে তিনি বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। ওয়াহিদ সাদিক ও শাবানা দম্পতি দুই মেয়ে ফারহানা সাদিক সুমি ও সাবরিনা সাদিক ইয়েল উর্মি। বড় মেয়ে ফারহানা সাদিক সিপিএ করে চাকরি করছেন, ছোট মেয়ে সাবরিনা সাদিক ইয়েল শিকাগো হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটিতে শিক্ষকতা করেন। একমাত্র পুত্র শাহিন সাদিক নিউ জার্সির রাদগার্স বিশ্ববিদ্যালয় থেকে লেখাপড়া করে চাকরি করছেন। শাবানা অভিনীত উল্লেখযোগ্য এবং দর্শক প্রিয় ছবি- ‘ঘাতক’ ‘সখি তুমি কার’ ‘অবুঝ মন’ ‘স্নেহ’ ‘ঘরের শত্রু’ ‘কন্যা দান’ ‘দুই পয়সার আলতা’ ‘অপেক্ষা’ ‘জননী’ ‘স্বামী কেন আসামী’ ‘অবুঝ সন্তান’ ‘সত্যের মৃত্যু নেই’ ‘নাজমা’ ‘ভাত দে’ ‘রাঙ্গা ভাবি’ ‘গরিবের বউ’ ‘মরণের পরে’ ‘অচেনা’ প্রভৃতি। শিশু শিল্পী হিসেবে তাঁর প্রথম ছবি ছিল ‘নতুন সুর’ এবং শাবানা অভিনীত শেষ ছবি ১৯৯৭ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত আজিজুর রহমান পরিচালিত ‘ঘরে ঘরে যুদ্ধ’।
সাবলীল বাস্তবধর্মী হৃদয়গ্রাহী শিল্পসম্মত অভিনয়ের জন্য শাবানা ১০বার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান। ১৯৭৭ সালে ‘জননী’ ছবির জন্য পার্শ্ব অভিনেত্রী হিসেবে, ১৯৮০ সালে “সখী তুমি কার”, ১৯৮২ সালে ‘দুই পয়সার আলতা’, ১৯৮৩ সালে ‘নাজমা’, ১৯৮৪ সালে ‘ভাত দে’, ১৯৮৭ সালে ‘অপেক্ষা’, ১৯৮৯ সালে ‘রাঙ্গা ভাবী’, ১৯৯০ সালে ‘মরণের পরে’, ১৯৯১ সালে ‘অচেনা ‘ ছবিতে অনবদ্য অভিনয়ের জন্য শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীর পুরস্কার পান। তিনি ১৯৮৯ সালে ‘গরীবের বউ’ প্রযোজনার জন্য শ্রেষ্ঠ প্রযোজক হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান। তিনি মস্কো চলচ্চিত্র ফেস্টিভ্যাল, কান চলচ্চিত্র ফেস্টিভেল, রোমানিয়া চলচ্চিত্র ফেস্টিভেলে অংশগ্রহণ করে আন্তর্জাতিক সম্মান অর্জন করেন।
বর্তমানে তিনি চলচ্চিত্র থেকে দূরে আছেন এবং স্বামী সন্তান নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউ জার্সিতে স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন।