আজ থেকে বহুকাল আগের ঘটনা। ইরাকের বসরা নগরীতে ওই সময় এক লোক বাস করত। লোকটা ছিল ভয়ঙ্কর দুর্ধর্ষ, নৃশংস ও দুঃসাহসীও বটে। তার নাম ছিল কুর্দি। সে ছিল পেশায় একজন ডাকাত। তার ছিল কিছু সাগরেদ। ওরা দলবদ্ধ হয়ে প্রায় প্রতি রাতে ডাকাতি করে বেড়াত। তার জন্য কত লোকের জান মালের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তার হিসেব নেই। কুর্দি ডাকাত তার দলবল নিয়ে নিজের গ্রাম ছাড়া আশপাশের গ্রামসহ দূর- দূরান্তের গ্রামেও যেত ডাকাতি করতে।
একদিনের ঘটনায় কুর্দি ডাকাতের জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিল। তার জীবনে নেমে এলো এক অদ্ভুত পরিবর্তন। সে সত্য পথের সন্ধান পেল। ঘটনার দিন সে তার দলবল নিয়ে দূরের এক গ্রামে ডাকাতির উদ্দেশ্যে রওনা হলো। তখন দিন। রাত নামতে অনেক বাকি। তবে রাত আসার আগেই গ্রামে কার বাড়িতে ডাকাতি করলে বেশি মাল সামান পাওয়া যাবে তার জন্য ডাকাতদের মধ্যে একজনকে পাঠালো ছদ্মবেশে গ্রামের ভিতরে। তার উদ্দেশ্য গোপনে গুপ্তচর বৃত্তি করে সেই গৃহস্থের বাড়িটাকে চিহ্নিত করে আসা। কুর্দি ডাকাত তার সাঙ্গোপাঙ্গ নিয়ে একটি খেজুর বাগানে আশ্রয় নিলো। অনেক পথ আসার ফলে সবাই প্রায় ক্লান্ত। কেউ কেউ বাগানের ছায়ায় ঘুমিয়েও পড়ল। কিন্তু কুর্দির চোখে ঘুম নেই। গুপ্তচরের ফিরে আসার অপেক্ষায় সে বাম হাতের ওপর মাথা দিয়ে কাত হয়ে পথের দিকে তাকিয়ে থাকল। এমন সময় হঠাৎ দেখতে পেল একটি ছোট্ট সুন্দর পাখি। পাখিটার ডানা দুটো সবুজ, ঠোঁট লাল, পা দুটো কিঞ্চিৎ হলুদ। আরো সামনে তাকিয়ে দেখল পাশাপাশি দুটো খেজুর গাছ। একটি খেজুর গাছে লাল টুকটুকে কাঁদি ভরা খেজুর। আর অন্য খেজুর গাছটি মরা। মরা খেজুর গাছটির মাঝখানে একটি গর্ত। ওই গর্তে পাখিটি পাকা খেজুর মুখে নিয়ে ঢুকছে আর কিছুক্ষণের মধ্যেই খেজুরটি ছাড়াই বেরিয়ে আসছে। কুর্দি ডাকাত ভাবল হয়তো পাখিটির ছানাকে খেজুর খাওয়াচ্ছে। কিন্তু ওর ভাবনায় ছেদ পড়ল। এখন তো ঐ পাখিটির প্রজননের সময় না। তাছাড়া ওর ছানা হলে পোকা মাকড় কীট পতঙ্গ নিয়ে খাওয়াবে। খেজুর কেন? কুর্দি ডাকাত কৌতূহলী হয়ে উঠল। তার মনের ভিতর জাগা প্রশ্নের জবাব খুঁজতে উঠে পড়ল শোয়া থেকে। এবার সে নিজেই তর তর করে মরা খেজুর গাছটায় উঠে তাতে উঁকি দিয়ে দেখল। দেখেই তো কুর্দির চক্ষু ছানাবড়া। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না। দেখল তাতে একটি সাপের বাচ্চা। পাখিটি ওই সাপের বাচ্চাটিকেই খেজুর খাওয়াচ্ছে।
কুর্দি ডাকাত আল্লাহর অসীম কুদরতের এমন অবিশ্বাস্য কুদরত দেখে আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার বলে চিৎকার করে উঠল। তার মন প্রাণ এক অজানা আতঙ্কে শিহরিত হয়ে উঠল। কোন রকমে গাছ থেকে নেমে আল্লাহর কাছে কাঁদতে কাঁদতে সেজদায় পড়ে গেল। অনুশোচনায় সে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইল। জীবনে কত শত অন্যায় করেছে পাপ করেছে সেই পাপের সীমা নেই। অতীতের সকল গুনাহের জন্য আল্লাহর কাছে বলতে থাকে- হে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন অসীম দয়ালু রহমানুর রহিম আপনি আমাকে ক্ষমা করে দিন। আমি এতদিন ভুলের মধ্যে, অন্ধকারের মধ্যে নিমজ্জিত ছিলাম। অন্যায় ভাবে ডাকাতি করে, অন্যের আহার গ্রাস করে নিজের ক্ষুধা মিটিয়েছি। কিন্তু সব ভুল আমার ভেঙে গেছে। আপনি ইচ্ছে করলে সৃষ্টির কোন সৃষ্টিকে অনাহারে রাখেন না। সবাইকে আহার দিতে পারেন। যা আমি আজ নিজের চোখে দেখলাম। আমি তওবা করছি। আজ থেকে আর কোনদিন আমি ডাকাতি বা অন্য কোন অন্যায় পথে পা বাড়াবো না। আমার তওবা আপনি কবুল করুন।
এদিকে বেলা ডুবে এলো প্রায়। পশ্চিম দিগন্ত গোধূলি রঙে রেঙে উঠেছে। গুপ্তচরটিও ততক্ষণে ফিরে এসেছে। কুর্দি ছিল ডাকাতের সর্দার। কুর্দি গুপ্তচরটির কোন সংবাদ দেয়ার আগেই বলে উঠল: তোমরা আমার কথা মন দিয়ে শোন। আমি মনস্থির করেছি আর কোনদিন পাপের পথে পা বাড়াব না। ডাকাতিও করব না। আমি আল্লাহকে চিনতে পেরেছি। তিনি আমাদের সৃষ্টি করেছেন। সেই মহান রব আমাদের ¯্রষ্টা। তাঁর শ্রেষ্ঠ জীবের জীবন ধারণের জন্য সঠিক ব্যবস্থাও করে রেখেছেন। তবে কেন আমরা অসৎপথে রুজি রোজগার করে আমাদের আখেরাতকে ধ্বংস করব?
এসো আমরা সবাই অসৎ পথ থেকে ফিরে আসি। তোমরা যদি ফিরে আসো আমি দারুণ খুশি হবো। আল্লাহ রাব্বুল আলামিনও আমাদের প্রতি খুশি হবেন। কুর্দি ডাকাত সর্দারের এমন কথায় সবাই অবাক হলো। তারা ভাবলো এইটুকু সময়ের মধ্যে এমন আমূল পরিবর্তন ডাকাত সর্দারের কী করে হলো। তারা তাকে জিজ্ঞেসও করলো। কুর্দি ডাকাত সর্দার তখন পাখি ও সাপের বাচ্চার ঘটনাটি খুলে বলল। ঘটনা শুনে অন্য ডাকাতরাও সবাই তওবা করে নতুন জীবন শুরু করার অঙ্গীকার করল। সাথে সাথে আরও একটি অঙ্গীকার করল, এবার তারা সবাই পবিত্র হজব্রত পালন করে তবেই বাড়ি ফিরে যাবে। যাতে আল্লাহ তাদের সমস্ত গুনাহ মাফ করে দেন।
সবাই পবিত্র মক্কার উদ্দেশে রওনা দিল। কিন্তু সাথে তেমন টাকা পয়সা নেই। যা আছে যৎসামান্য। তবুও তারা আল্লাহর নামে বেরিয়ে পড়ল। কোন রকম দুশ্চিন্তা তাদের আসলো না। তারা এগিয়ে চলল শুধু আল্লাহর রহমত ও করুণাকে পাথেয় করে।
এই ভাবে চলতে চলতে একদিন রাত্রি যাপনের জন্য এক বৃদ্ধা মহিলার বাড়িতে আশ্রয় নিলো। বৃদ্ধার কোন আপনজন নেই। তাই তিনি মেহমান মুসাফিরদের পেয়ে খুব খুশি হল। তাদেরকে প্রাণ ভরে খানাপিনা আপ্যায়ন করল। খাবার শেষে বৃদ্ধা প্রশ্ন করল আপনারা কি বসরা থেকে এসেছেন? কুর্দি তখন জানাল হ্যাঁ আমরা বসরা থেকেই এসেছি। তখন বৃদ্ধা বলল: আচ্ছা আপনারা কি বসরার কুর্দি ডাকাতকে চেনেন? যারা কিনা একটি দলবল নিয়ে মক্কার পবিত্র হজের জন্য বেরিয়েছেন? বৃদ্ধার মুখে এমন কথা শুনে সবাই বিস্মিত হলো। কুর্দি ডাকাতও ভাবনার অতলে তলিয়ে গেল। এই বৃদ্ধার সঙ্গে কখনও কুর্দি ডাকাতের দেখা সাক্ষাৎ কিংবা আলাপ পরিচয় নেই অথচ তার নাম জানলেন কী করে? সবিনয়ে কুর্দি বলল, আপনি তাকে চেনেন? কখনও দেখেছেন?
বৃদ্ধা জবাব দিলেন, আমি তাকে দেখিনি ঠিকই কিন্তু গত পরশু রাতে আমি স্বপ্নে দেখলাম- দু-একদিনের মধ্যে আমার বাড়িতে একদল ডাকাত রাত্রি যাপনের জন্য আশ্রয় চাইবে। আমি যেন তাদের আশ্রয় দেয়। তারা অসৎ পথ পরিত্যাগ করে অন্ধকার থেকে আলোর পথে প্রত্যাবর্তন করেছে। তাদের টাকা কড়ি শেষ হয়ে গেছে। তুমি তাদের কিছু স্বর্ণমুদ্রা দিয়ে তাদের সাহায্য করবে যাতে তারা নির্বিঘেœ হজের জন্য মক্কায় উপস্থিত হতে পারে।
সেই থেকে আমি তাদের প্রতীক্ষায় আছি। কখন তারা এসে আমার বাড়িতে মেহমান হবে। বৃদ্ধার কথা শোনা মাত্রই সকলেই আল্লাহু আকবার বলে সিজদায় লুটিয়ে পড়ল। তাদের সিজদারত দেখে বৃদ্ধার বুঝতে বাকি রইল না যে তারাই সেই দল। যার কথা বৃদ্ধা স্বপ্নে দেখেছিলেন। খুশিতে বৃদ্ধার চোখে পানি টলমল করতে থাকে। এমন অভূতপূর্ব দৃশ্য কুর্দি ডাকাতের দলবলও কান্নায় শরিক হয়ে মহান আল্লাহর শোকরজারি করতে থাকে।