আলোড়ন সাহিত্য পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি কবি আল ওয়াহিদ খুলনার জিয়া হলে আয়োজন করে একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের। সেখানে চলচ্চিত্র পরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান, নায়িকা পপি ও আমাকে পুরস্কার দেওয়া হয়। বিশাল বর্ণাঢ্য এই অনুষ্ঠানে আমাদের হাতে পুরস্কার তুলে দেন চলচ্চিত্রের ইতিহাসখ্যাত পরিচালক ও অভিনেতা সুভাষ দত্ত। শশ্রু মন্ডিত গেরুয়া পোষাক পরিহিত হাস্যজ্জ্বল চেহারার সুভাষ দত্ত হাসিমুখে সবার সাথে কুশল বিনিময় করেন। চলচ্চিত্রের জীবন নিয়ে তার জ্বালাময়ী বক্তব্য সবাইকে উদ্বুদ্ধ করে। একসময় অতি ব্যস্ত এই নির্মাতা ও অভিনেতা শেষ বয়সে এসে সন্ন্যাস্য গ্রহণ করেন। তিনি রামকৃষ্ণ মিশনে নিজেকে মানব সেবায় বিলিয়ে দেন। মানবতার মাঝে প্রেম, মানবতার মাঝে উদ্দীপনা, মানবতার মাঝে সৃষ্টি, মানবতার মাঝে এই সংসার- এসব তিনি সকলকে বোঝাতেন। উদ্বুদ্ধ করতেন মানবতার মাঝে নিজেকে সম্পৃক্ত করার জন্য। সাধারণ মানুষ তাঁর এই কর্মকান্ডে অবাক হয়ে যেত। রুপালি পর্দার মানুষ বাস্তবে এসে নিজেকে এমনভাবে ক’জন দেখেছে? সুভাষ দত্ত দেখিয়ে গেলেন সৃষ্টির মাঝে জীবন। যেমন করে তিনি ষাটের দশকে চলচ্চিত্রকে দেখিয়েছিলেন সৃষ্টিশীল এক কারিশমা। একদিকে তিনি ছিলেন চলচ্চিত্রের শিল্পনির্দেশক, অভিনেতা: অন্যদিকে ছিলেন সেরা সেরা ছবির নির্মাতা।
সুবাস দত্ত বগুড়ার মানুষ। ১৯৩০ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি মামার বাড়ি দিনাজপুরের মুন্সিপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। কিন্তু বড় হয়ে ওঠেন ঢাকার রামকৃষ্ণ মিশনের নিজে বাড়িতে। চলচ্চিত্রের পোকা তার মাথায় ঢোকে। তিনি ঢাকা থেকে চলে যান মুম্বাই। সেখানে সিনেমা স্টুডিওতে চাকরি নেন, বেতন মাসিক মাত্র ৩০ টাকা। দেশে ফিরে আসেন হাজার ১৯৫৩ সালে। তখন এদেশে কোন ছবি নির্মাণের সুযোগ ছিল না। এজন্য সুভাষ দত্ত যুক্ত হন পোস্টার ছাপা প্রতিষ্ঠান এভারগ্রীণ। চমৎকারভাবে পোষ্টার আঁকতে পারতেন তিনি। তাঁর প্রতিভার পুরোপুরিভাবে প্রকাশ ঘটে এদেশের প্রথম সবাক চলচ্চিত্র আব্দুল জব্বার খান পরিচালিত ‘মুখ্ ও মুখোশ’ এর পোস্টারের ডিজাইন করে। ছবিটি ১৯৫৬ সালে মুক্তি পায়। তিনি কাজ করেন এহতেশাম পরিচালিত ‘মাটির পাহাড়’ ছবিতে ১৯৫৯ সালে। ‘এ দেশ তোমার আমার’ ছবিটিতে সুভাষ দত্ত কমেডি চরিত্রে অভিনয় করে তাঁর সরব উপস্থিতি সকলকে জানিয়ে দেয়। ১৯৬১ সালে মুক্তি পায় তাঁর অভিনীত ‘হারানো দিন’। ছবিটি ব্যবসা সফল হয়। সুভাষ দত্ত কে নিয়ে ইন্ডাস্ট্রিতে সাড়া পড়ে যায়। একের পর এক ছবিতে তিনি অভিনয় করতে থাকেন। ১৯৬৩ সালে নবাগত নায়িকা কবরীকে নিয়ে তিনি নির্মাণ করেন ‘সুতরাং’। ছবিটি ১৯৬৪ সালে মুক্তি পায়। ফ্রাঙ্কফুট চলচ্চিত্র উৎসবে ‘সুতরাং’ পুরস্কৃত হয়। বিশ্বে আলোড়ন তোলে ছবিটি। বক্স অফিস হিট হয়। দর্শক চলচ্চিত্র জগতে পায় এক মিষ্টি মেয়ে। নাম যার কবরী। যাঁর সৃষ্টির কারিগর সুভাষ দত্ত। সুভাষ দত্ত পরিচালিত ১৯৬৮ সালে মুক্তি পায় ‘আবির্ভাব’ এবং ১৯৭০ সালে মুক্তি পায় ‘বিনিময়’। তিনি একের পর এক ছবি নির্মাণ করে চলেন এবং মাঝে মাঝে অভিনয়ও করেন। এরপর আসে মহান মুক্তিযুদ্ধ। আর এই মুক্তিযুদ্ধকে নিয়ে সুভাষ দত্ত জীবনের সেরা ছবিটি নির্মাণ করেন। যার নাম “অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষী”। মুক্তিযুদ্ধে লাঞ্চিত অপমানিত নারীদের পুনর্বাসনের জন্য ছবিটি ছিল মেসেজ- যা সারা দেশকে নাড়িয়ে দেয়। মুক্তিযুদ্ধের এই চলচ্চিত্রটি বাংলাদেশের একটি অনন্য মাইলফলক।
আমি তখন দৈনিক বাংলার বাণী চলচ্চিত্র পাতায় মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্রের নির্মাণ নিয়ে ধারাবাহিক লেখালেখি লিখছি। এরই ধারাবাহিকতায় “অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষী”র পরিচালক সুভাষ দত্তের মুখোমুখি হলাম এফডিসির পরিচালক সমিতির অফিসে। তিনি নির্মাণের চিন্তা, মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্বুদ্ধকরণের কাহিনী, মুক্তিযুদ্ধে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সাহসিকতার কথা, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে এদেশে নারীদের উপর যে নির্যাতন নেমে আসে এবং নির্যাতিতদের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের পরবর্তী সময়ের অবস্থা কি হতে পারে তা নিয়ে চিন্তা করতে করতে সুভাষ দত্ত নির্মাণ করেন “অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষী”।
দেশে একজন সৃজনশীল চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসেবে সুভাষ দত্তের নাম চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। পরবর্তীতে তিনি ১৯৭৭ নির্মাণ করেন আলাউদ্দিন আল আজাদের ২৩ নম্বর তেলচিত্র অবলম্বনে ‘বসুন্ধরা চলচ্চিত্র’। “বসুন্ধরা” চলচ্চিত্রের মাধ্যমে জনপ্রিয় নায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন পর্দায় আসেন। সৃজনশীল ছবি হিসেবে “বসুন্ধরা” পাঁচটি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৭৮ সালে মুক্তি পায় ডক্টর আশরাফ সিদ্দিকীর গল্প “গলির ধারের ছেলেটি” অবলম্বনে সুভাষ দত্তের চলচ্চিত্র “ডুমুরের ফুল”। নির্মিত হিসেবে উপবাস দত্তের উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্র হলো – “কাগজের নৌকা” “আয়না ও অবশিষ্ট” “পালা বদল” “আলিঙ্গন” “আকাঙ্ক্ষা” “সকাল সন্ধ্যা” “ফুলশয্যা” “সবুজসাথী” “নাজমা” “স্বামী স্ত্রী” “আমার ছেলে” প্রভৃতি।
সুভাষ দত্ত শুধু চলচ্চিত্র নির্মাণই করেন নাই তিনি মন উজাড় করে বাস্তব অভিনয় নিজেকে জড়িয়ে নেন একের পর এক চলচ্চিত্র। তাঁর অভিনীত চলচ্চিত্র গুলোর ভেতর উল্লেখযোগ্য- “রাজধানীর বুকে” “হারানো দিন” “সূর্যস্নাণ” “চান্দা” “তালাশ” “নতুন সুর” “রূপবান” “মিলন” “নদী ও নারী” “ভাইয়া” “আলিঙ্গন” “ফির মিলেঙ্গে হাম দোনো” “ক্যায়সে কাহু” “আখেরি স্টেশন” “সোনার কাজল” “দুই দিগন্ত” “সমাধান” “আয়না” প্রভৃতি। সুভাষ দত্ত যখন যেখানে হাত দিয়েছেন সেখানেই তিনি স্বার্থক।
চলচ্চিত্রে দীর্ঘ সময় ধরে সুভাষ দত্ত ছিলেন। ১৯৫৬ সালে প্রথম চলচ্চিত্র “মুখ ও মুখোশ” থেকে ২০০৮ সালে নিজের পরিচালিত সর্বশেষ ছবি “আমার ছেলে”। সবখানেই তার সরব উপস্থিতি ও সাবলীল বিচরণ এবং ঈর্ষনীয় জনপ্রিয়তা ক’জনের ভাগ্যে জোটে?
সুভাষ দত্তের হাত ধরে পর্দায় এসে জনপ্রিয়তা পেয়েছেন সুচন্দা (কাগজের নৌকা), ইলিয়াস কাঞ্চন (বসুন্ধরা), কবরী (সুতরাং), উজ্জ্বল (বিনিময়), শর্মিলী আহমেদ (আবির্ভাব), খান জয়নুল (সুতরাং), বেবি ইসলাম (সুতরাং)। সুভাষ দত্ত যতক্ষণ অভিনয়ে তুষ্ট না হতেন ততক্ষণ ধরে সেই অভিনেতা বা অভিনেত্রীর অভিনয়ের অনুশীলন করতেই হতো। এ প্রসঙ্গে মিষ্টি মেয়ে নায়িকা কবরী বলেন- সুভাষ দত্ত না হলে আমি অভিনয় পারদর্শী হতে পারতাম না।
অভিনয় এবং পরিচালনার জন্য সুভাষ দত্ত আন্তর্জাতিক পুরস্কারসহ দেশীয় বহু পুরস্কারে ভূষিত হন। ১৯৬৫ সালে ফ্রাংকফুট চলচ্চিত্র উৎসবে “সুতরাং” চলচ্চিত্রটি ২য় শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র হিসেবে পুরস্কৃত হয়।
সুভাষ দত্ত ১৯৬৭, ১৯৭৩, ১৯৭৯ সালে মস্কো চলচ্চিত্র উৎসব এবং ১৯৬৫ সালে পাকিস্তান চলচ্চিত্র উৎসবে সহ-অভিনেতার পুরস্কার পান। নমপেন আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে ১৯৬৮ পুরষ্কৃত হয় সুভাষ দত্তের চলচ্চিত্র। “বসুন্ধরা” চলচ্চিত্রের ৫টি শাখায় ১৯৭৭ সালে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করে। বাংলাদেশ সরকার ১৯৯৯ সালে সুভাষ দত্তকে একুশে পদকে ভূষিত করে।
এই মহান সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, চলচ্চিত্র নির্মাণের এই প্রখ্যাত কারিগর ২০১২ সালের ১৬ নভেম্বর না ফেরার দেশে চলে যান।