আবু ইউসুফ:
ক্রমাগত পানি বাড়তে থাকায় কুমিল্লার জলাঞ্চল নামে পরিচিত মনোহরগঞ্জ উপজেলায় দেখা দিতে পারে মানবিক বিপর্যয়। এ উপজেলায় তীব্র সংঙ্কট দেখা দিয়েছে খাদ্য ও বিশুদ্ধ পানির। স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যায় শতভাগ ঘরবাড়ি আর নলকূপ ডুবে যাওয়ায় ছড়িয়ে পড়তে পারে এলার্জি, পানিবাহিত বিভিন্ন রোগবালাইসহসহ চরম মানবিক বিপর্যয় দেখা দিতে পারে, বলে আশঙ্কা করছেন বিশিষ্টজনেরা।
ইতোমধ্যে উপজেলার হাসনাবাদ, বাইশগাঁও, লক্ষ্মণপুর, সরসপুর, নাথেরপেটুয়া, বিপলাসার, খিলা, মৈশাতুয়া, উত্তর হাওলা, ঝলম উত্তর, ঝলম দক্ষিণ ইউনিয়নের ৬০ হাজার পরিবারের প্রায় ৩ লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। পানিতে ডুবে গেছে বসতঘর, তলিয়ে গেছে ফসলি জমি। পুকুর-দিঘি থেকে শুরু করে মাছের ঘের ও পোল্ট্রি খামার সব কিছুই প্লাবিত হয়েছে। বন্ধ হচ্ছেনা ভারি বৃষ্টি, ভয় আতঙ্কের মাঝে দিন পার করছে মানুষজন।
অসহায় কিছু মানুষ পাশ্ববর্তী উঁচু দালান ও আশ্রয় কেন্দ্রে আশ্রয় নিলেও অধিকাংশ মানুষ পানিবন্দি। রাস্তা ঘাট তলিয়ে যাওয়া এবং নৌকা সংকটের কারণে পানিবন্দিদের কাছে পৌঁছাতে পারছেনা স্বেচ্ছাসেবীরা।
গত দুই দিন উপজেলার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, বন্যাকবলিত বেশির ভাগ এলাকায় মানবিক বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। অনেকে পানির সীমাহীন কষ্টের মধ্যে বসবাস করছে। ঘরে চাল ডাল থাকলেও আগুন জ্বালানোর জায়গা না থাকায় রান্না করা যাচ্ছেনা, না খেয়েই দিন কাটাতে হচ্ছে তাদের। ক্ষধায় ছটপট করছে বৃদ্ধ আর শিশুরা।
দুর্গতদের অভিযোগ প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম ত্রাণ সরবরাহ করা হচ্ছে। উপজেলার সরকারি হিসাবে প্রায় ৬ হাজার পরিবার পানিবন্দি, এসব আশ্রয় কেন্দ্রগুলোতে দেওয়া হচ্ছে শুকনো খাবার দেয়া হলেও, গ্রামের ভেতর বাড়িতে আটকে পড়া অসহায় মানুষদের কাছে প্রয়োজনীয় ত্রাণ যাচ্ছে না, তাই এখানকার বানভাসি প্রায় ৩ লাখ মানুষ মানবেতর জীবনযাপন করছেন। তাদের অভিযোগ বন্যার ভয়াবহতার প্রচার না থাকায় বাইরের কোনো স্বেচ্ছাসেবী তাদের উদ্ধার করতে আসছে না যার ফলে তারা ত্রাণও পাচ্ছেন না।
মঙ্গলবার উপজেলার একাধিক ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রচার না থাকায় এখানে ত্রাণ ও উদ্ধার কাজ করা বাইরের স্বেচ্ছাসেবকরা একদম আসছেন যার কারণে এ উপজেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলের পানিবন্দি মানুষের মধ্যে হাহাকার বেড়েই চলেছে।
এদিকে কয়েকদিন থেকে উপজেলার হাট বাজারগুলোতে নিত্যপণ্যের সংকট দেখা দিয়েছে আর এই সুযোগে অসাধু ব্যবসায়ীরা দাম বাড়িয়ে গলা কাটছে সাধারণ মানুষের।
এছাড়া উপজেলায় গ্যাস সিলিন্ডারের তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। গ্যাস সংকটের কারণে উপজেলার বন্যার্তদের দুর্ভোগ আরও বেড়েছে। অনেক পরিবার গ্যাসের অভাবে রান্না করতে পারছে না। অভিযোগ রয়েছে, সংকটের সুযোগে এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী সাড়ে ১২ কেজির সিলিন্ডার ১৪০০ টাকার পরিবর্তে ২৫০০থেকে ৩ হাজার টাকায় বিক্রি করছেন। স্থানীয় দোকানপাটেও তেমন খাদ্যসামগ্রী নেই, থাকলেও দাম অনেক বেশি নেওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে, যার ফলে সাধারণ মানুষ জিম্মি হয়ে পড়েছেন। এসব বিষয়ে তদারকিসহ এ উপজেলাকে দ্রুত দুর্গত এলাকা ঘোষণা করে পর্যাপ্ত ত্রাণ সহায়তা দেওয়া দরকার বলে মনে করছেন বিশিষ্টজনেরা।
তারা আরো বলছেন ভয়াবহ বিভীষিকা পরিস্থিতির সাথে যুদ্ধ করতে হচ্ছে এখানকার অসহায় মানুষগুলোকে।
এদিকে নিত্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে অভিযান নেমেছে উপজেলা প্রশাসন। তবে নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছেনা তাদের।
হাসনাবাদ ইউনিয়নের বাসিন্দা আবদুল মান্নান বলেন, সকালে বাজারে গ্যাস কিনতে গিয়ে দেখি প্রতি সিলিন্ডার গ্যাস বিক্রি হচ্ছে ২ হাজার থেকে ২৫০০ টাকায়।বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্যের দামও বাড়ানো হয়েছে।
পরিচয় গোপন রেখে একজন বলেন, এ উপজেলা আগে থেকেই জলাঞ্চল নামে পরিচিত। এ উপজেলা নিন্মাঞ্চল হওয়ায় পানিতে মানুষ খুবই কষ্ট পাচ্ছে। পানিবন্দি মানুষদের উদ্ধারে নৌকা ও স্পিডবোট দরকার। কিন্তু এখানে তেমন কোনো সহায়তা এখনো আসেনি। মানুষ কষ্টে আছে। বন্যার কারণে লাড়কির সংগ্রহ করতে পারছে না। অপরদিকে ঘরের ভেতরে পানি উঠে যাওয়ায় মাটির চুলাতেও রান্না করতে পারছি না। রান্নার জন্য বেড়েছে গ্যাস সিলিন্ডারের চাহিদা। এই সুযোগে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী দাম বাড়িয়েছেন। বাধ্য হয়ে বেশি দামে কিনতে হচ্ছে গ্যাস সিলিন্ডার।
উপজেলার মনোহরগঞ্জ বাজারের এক ব্যবসায়ী বলেন, যে কয়েকটি গ্যাস সিলিন্ডার ছিল তা বিক্রি হয়ে গেছে। ডিলারদের সাথে যোগাযোগ করেও আমরা গ্যাস সিলিন্ডার পাচ্ছিনা। তিনি আরও বলেন অনেকেই একটু বেশি দামে গ্যাস সিলিন্ডার বিক্রি করছে।
আলীনকিপুর স্কুলের আশ্রয় কেন্দ্রে অবস্থানরত একজন বলেন, এখানে আমরা মানুষের দেওয়া রান্না খাবার ও মুড়ি-বিস্কুটসহ শুকনো খাবার খেয়ে গত দুদিন পার করছি।
মনোহরগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) উজালা রানী চাকমা বলেন, উপজেলার বন্যা পরিস্থিতি প্রতিনিয়ত অবনতির দিকে যাচ্ছে। আজও পানি কিছুটা বেড়েছে। মনোহরগঞ্জ উপজেলায় অনেক দুর্গম এলাকা রয়েছে যেখানে নৌকা ছাড়া যাওয়া একেবারেই অসম্ভব। আমাদের কাছে নৌকার প্রচুর সংকট রয়েছে। আমরা চেষ্টা করছি যেন একটা মানুষও অভুক্ত না থাকে। তবে আমাদের আরও অনেক সহায়তা দরকার। যা আসছে তা চাহিদার তুলনায় অনেক কম। আমি অনুরোধ করবো সরকারের পাশাপাশি বিত্তশালীরা বানভাসি মানুষের জন্য এগিয়ে আসুন।