আওয়ামী লীগ ও বিএনপি জোটের বাইরে গিয়ে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে একটি স্বতন্ত্র জোট গঠনের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল গত বছর (২০২২ সাল)। চরমোনাই পীর মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করীমের দল ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ এ প্রক্রিয়া শুরু করে। কয়েকটি ধর্মভিত্তিক দলের সঙ্গে সংলাপও করে তারা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা আলোর মুখ দেখেনি। মূলত ইসলামী আন্দোলনের প্রতি অন্য দলগুলোর অনাস্থা ও অবিশ্বাসের কারণে ওই জোট গঠন থমকে গেছে— এমন দাবি সংশ্লিষ্টদের।
ধর্মভিত্তিক দলগুলোর নেতারা বলছেন, কয়েকটি লক্ষ্য সামনে রেখে দীর্ঘদিন ধরে ধর্মভিত্তিক দলগুলো মধ্যে একটি স্বতন্ত্র জোট গঠনের আলাপ-আলোচনা চলছিল। এর মধ্যে অন্যতম লক্ষ্য ছিল আগামী সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ কিংবা বিএনপির সঙ্গে না গিয়ে আলাদা নির্বাচন করা। নিজেদের মধ্যে সমঝোতা করে এক আসনে ধর্মভিত্তিক দলগুলো থেকে একজনকে প্রার্থী দেওয়া। যাতে সব ধর্মভিত্তিক দল একজনকে ভোট দিয়ে নির্বাচিত করতে পারে।
এসব বিষয় সামনে রেখে ইসলামী আন্দোলনের ডাকে সাড়া দিয়ে তাদের সঙ্গে বৈঠক করে অন্য দলগুলো। কিন্তু পরে বিভিন্ন মাধ্যমে খবর ছড়িয়ে পড়ে যে সরকারি দল থেকে আসন ছাড়ের বিনিময়ে ‘বিশেষ সমঝোতা’ করেছে ইসলামী আন্দোলন। ফলে ধর্মভিত্তিক দলগুলোর স্বতন্ত্র জোট গঠনের সম্ভাবনা অনেকটা ভেস্তে যায়। তবে, এখনও যেহেতু নির্বাচনের অনেক সময় বাকি, যে কোনো সময় যে কোনো কিছুই হতে পারে— বলছেন তারা।
ধর্মভিত্তিক দলগুলোর স্বতন্ত্র জোট গঠনের প্রক্রিয়ার উদ্যোগ কত দূর এগোল— জানতে চাইলে ইসলামী আন্দোলনের মহাসচিব মাওলানা ইউনুছ আহমাদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, অনেকের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। আগামী নির্বাচন নিয়ে কথা হয়েছে। তবে, এখনও বলার মতো কিছু হয়নি।
‘প্রত্যেক দলের স্বতন্ত্র আদর্শ আছে। আমাদেরও নিজস্ব আদর্শ আছে। আমরা কাউকে ছাড় দিয়ে, কিংবা অন্যদের ছাড় দিয়ে জোটে আসার অনুরোধ করব না।’
সরকারি দলের সঙ্গে আসন ছাড় নিয়ে ‘বিশেষ সমঝোতার’ বিষয়ে জানতে চাইলে ইউনুছ আহমাদ বলেন, ‘আমাদের প্রতি ঈর্ষান্বিত হয়ে একটি মহল এ গুঞ্জন ছড়িয়ে দিয়েছে। তবে, এতে আমরা শঙ্কিত নই। কারও কাছ থেকে সুযোগ-সুবিধা নেওয়ার ইচ্ছা থাকলে আরও আগে নিতে পারতাম। সেই সুযোগ আমাদের ছিল।’
ইসলামী আন্দোলনের সঙ্গে গত বছর সংলাপ করেছিল খেলাফত মজলিস। দলটির মহাসচিব ড. আহমদ আবদুল কাদের বলেন, ‘গত বছর ইসলামী আন্দোলনের সঙ্গে আমাদের বৈঠক হয়েছিল। কিন্তু জোট গঠন নিয়ে এখনও কিছু হয়নি। এটা আরও পরে বোঝা যাবে, কিছু হবে কি না।’
সরকারের সঙ্গে ইসলামী আন্দোলনের সমঝোতার প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘বিষয়টি অনেকের কাছ থেকে শুনেছি। তাদের সঙ্গে সরকারের ঘনিষ্ঠতার বিষয়টি আমাদের কানে এসেছে। যেহেতু এখনও জোট হয়নি, তাই এটা নিয়ে এখনই কিছু বলতে চাই না। যদি আগামীতে আবার জোট গঠনের প্রক্রিয়া শুরু হয় তখন বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হবে।’
নাম না প্রকাশের শর্তে ধর্মভিত্তিক একটি দলের শীর্ষ নেতা বলেন, ইসলামী আন্দোলন একদিকে ধর্মভিত্তিক দলগুলোর একটি স্বতন্ত্র জোট গঠনের চেষ্টা করছে। অন্যদিকে, আগামী নির্বাচনে সরকারের কাছ থেকে আসন ছাড় নিয়ে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে— এমন কথাও আমাদের কাছে এসেছে। তার মানে হচ্ছে, তারা দুই নৌকায় পা দিয়ে আছে। যেদিকে বেশি সুবিধা পাবে সেদিকে যাবে। এটাই তো দাঁড়ায়। এ অবস্থা বিদ্যমান থাকলে তাদের সঙ্গে জোট গঠনের কোনো সম্ভাবনা নেই।
ধর্মভিত্তিক দলগুলোর নেতারা মনে করেন, তাদের মধ্যে ইসলামী আন্দোলনের ভোট বেশি— এটা অস্বীকার করার উপায় নেই। এ কারণে অতীতেও নানা সময় কথা দিয়ে কথা রাখেনি তারা। তারা মুখে বলে এক কথা, কাজে থাকে ভিন্নতা। এসব দলের নীতি-আদর্শে যেহেতু ভিন্নতা আছে, তাই চাইলেও সহজে জোট গঠন করা সম্ভব নয়। যদিও জোট গঠন করতে প্রত্যেক দলকে কিছু না কিছু ছাড় দিতে হয়।
ইসলামী আন্দোলনের সঙ্গে বৈঠক করেছিলেন বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন। দলটির আমির আতাউল্লাহ হাফেজ্জী ঢাকা পোস্টকে বলেন, তারা হাফেজ্জী হুজুরের কবর জিয়ারত করতে এসেছিলেন। তখন তাদের সঙ্গে বৈঠক হয়েছে। আমরা বলেছি, হাফেজ্জী হুজুরের নীতি ও আদর্শ মানলে জোট গঠন করতে রাজি। তাদের সঙ্গে বৈঠকে এতটুকু আলোচনা হয়েছে আমাদের।
আতাউল্লাহ হাফেজ্জীর দাবি, ‘তাদের বলেছি, আপনারা আলোচনায় বসে যেসব কথা বলেন, মাঠে-ময়দানে তার উল্টো পরিচয় দেন। আপনাদের কথা ও কাজে মিল থাকে না। এটা দেখতে হবে।’
আগামী নির্বাচনে তার দল অংশ নেবে— এমনটি জানিয়ে তিনি বলেন, ‘ধর্মভিত্তিক দলগুলোর মধ্যে জোট হলেও একটি বিষয় থাকবে। সেটি হলো, একটি আসনে যেন ধর্মভিত্তিক দলগুলোর একাধিক প্রার্থী না হয়। যেখানে যাদের সাংগঠনিক ক্ষমতা বেশি থাকবে সেই দলের যেন একক প্রার্থী হয়। সেটি না হলে যতগুলো আসনে আমাদের প্রার্থী দেওয়া সম্ভব হবে, ততগুলো আসনেই প্রার্থী দেব আমরা।’
ইসলামী আন্দোলনের সঙ্গে গত বছর সংলাপ করেছিল জামায়াত থেকে বেরিয়ে আসা লোকদের সমন্বয়ে গঠিত আমার বাংলাদেশ পার্টি (এবি পার্টি)। যদিও দলটির নেতাদের দাবি, তাদের সঙ্গে বৈঠকে ধর্মভিত্তিক দলগুলোর স্বতন্ত্র জোট গঠনের আলোচনার চাইতে বেশি প্রাধান্য পেয়েছে এবি পার্টির রাজনৈতিক আদর্শ নিয়ে। আমরা ধর্ম থেকে খারিজ হয়ে গেছি কি না, নাস্তিক কি না… ইত্যাদি বিষয়ে আলোচনা হয়েছে।
এবি পার্টির সদস্য সচিব মজিবুর রহমান মঞ্জু ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘আমরা তো তাদের সমমনা দল নই। আমরা শুনেছি, তারা জোট গঠন নিয়ে সমমনা ইসলামী দলের সঙ্গে আলোচনা করেছে। আমাদের সঙ্গে জোট গঠন নিয়ে আলোচনা হয়নি। রাজনৈতিক দল হিসেবে সম্প্রীতি রক্ষার আলোচনা হয়েছে। তারা তাদের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানায়, আমরা যাই। তেমনি আমরা আমাদের অনুষ্ঠানে তাদেরও আমন্ত্রণ জানাই। আমাদের প্রথম লক্ষ্য হচ্ছে সব দলের সঙ্গে জাতীয় ঐক্য করা ও সুসম্পর্ক বজায় রাখা।’
ধর্মভিত্তিক দলের বাইরেও গত বছর সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টির সঙ্গে বৈঠক করেছিল ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ। বৈঠকে আগামী নির্বাচনকে কেন্দ্র করে জোট গঠন প্রক্রিয়া নিয়ে আলোচনা হয়। যদিও পরবর্তীতে তার কোনো অগ্রগতি হয়নি। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ কাদের ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘যেহেতু নির্বাচনের অনেক সময় আছে, দেখা যাক কী হয়। তারা আমাদের অফিসে এসেছিল, আলোচনা হয়েছে। আমরা এখন আপাতত ৩০০ আসনে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছি।’