রবিউল ইসলাম:
ভাই এই বালা দুটো নিয়ে আমাকে ৬০০০ টাকা দিতে পারবেন ? আমার ছেলের ফর্ম ফিলাপ কালকে। আজকেই টাকাটা পাঠাতে হবে৷
” যা ছিলো সবই তো ছেলের পিছনে খরচ করলা। এখন এই শেষ সম্বল কি ছেলের জন্য হারাবা নাকি৷ ছেলেকে এত পড়ালেখা করিয়ে কি লাভ হবে। তার থেকে কাজে পাঠিয়ে দাও। তোমারও আর মানুষের বাসায় কাজ করতে হবেনা৷ ধারও শোধ করতে পারবা৷
মুনসুর খানের কথা শুনে রহিমা বেগম বললেন, আমার ছেলে লেখাপড়া করে যখন ভালো একটা চাকরি পাবে তখন আর আমার কোন কষ্ট থাকবেনা। এখন যত কষ্ট হউক তা ছেলের ভবিষ্যতের জন্য মানিয়ে নিবো।
‘ আগেও অনেক টাকা নিয়েছো সেগুলো এখনও শোধ করোনি। এখন এই বালা দিয়ে টাকা নিতে চাচ্ছো তাহলে আগের টাকা কিভাবে শোধ করবে?
‘ আমার ছেলে চাকরি পেয়ে সব শোধ করে দিবে৷
‘ ততদিনে সুদেআসলে কত বেড়ে যাবে তার হিসাব তো রাখোনা৷ পরে বলবে এত টাকা কিভাবে শোধ করবো৷ আর তোমার ছেলে চাকরি পেয়ে যে আমার টাকা শোধ করবে তার কি নিশ্চয়তা আছে?
‘ জমির কাগজ তো আপনার কাছে আছেই। টাকা শোধ করতে না পারলে জমি নিয়ে নিবেন
রহিমা বেগম টাকাটা নিয়ে বিকাশের দোকানে গিয়ে ছেলেকে পাঠালো। তারপর বিকাশের দোকান থেকেই ছেলেকে কল দিলো,
‘ টাকা এসেছে মা? কোথায় পেলে এতগুলো টাকা?
‘ হাতের বালা দুটো বিক্রি করে দিয়েছি বাবা।
‘ এটা তুমি কি করলে। বাবার দেওয়া ওটা শেষ সম্বল ছিলো।
‘ তুই আমার শেষ সম্বল বাবা। তুই ভালোভাবে পড়াশোনা কর তখন এরকম হাজারটা বালা আমাকে কিনে দিতে পারবি। তোর পড়াশোনার আর কত দিন বাকি আছে বাবা
‘ আর বেশিদিন নেই বাবা। এই পরিক্ষাটা শেষ হলেই পড়াশোনা শেষ। তারপর চাকরির খোজে নামবো।
‘ ভালোভাবে পড়াশোনা কর বাবা এখন রাখছি
রহিমা বেগম দোকানিকে টাকাটা দিয়ে বাসার দিকে আসে৷ পথে একজনের সাথে দেখা। রহিমা বেগমকে বলে, শুনলাম তুমি নাকি আবার ছেলের জন্য টাকা নিয়েছো ছেলের জন্য নিজেদের সবকিছু শেষ করে দিলে৷ তোমার ছেলে চাকরি না পেলে তখন কি হবে৷ আজকাল তো কত ছেলেই আছে চাকরি পাবার পর বাবা- মার খোজ নেয়না। তোমার ছেলেও যদি তোমার সাথে এরকম করে তখন কোথায় যাবা? স্বামীর যা কিছু ছিলো সবই তো ছেলের জন্য শেষ করে দিলে
রহিমা বেগম তার কথার কোনো উত্তর না দিয়ে পাশ কাঁটিয়ে চলে গেলো। আশেপাশের সব লোকজনই রহিমা বেগমকে এখন এরকমটা বলে৷ রহিমা বেগম কারও কথায় কান দেয়না। তার ইচ্ছে ছেলে লেখাপড়া করে ভালো চাকরি করবে। তার স্বামীরও এটাই ইচ্ছে ছিলো। মানুষের বাসায় কাজ করে ছেলের লেখাপড়া করিয়েছে৷ আর বেশিদিন নেই ছেলের লেখাপড়া শেষ হতে৷ ছেলের চাকরি হলে ছেলেকে বলবে, একটা শাড়ি কিনে দিতে৷ পরনেরটা অনেক জাগায় ছিড়ে গেছে৷ এটা পরে এখন ঠিকভাবে কাজও করা যায়না।
আলিয়ান আর কত পড়বে অনেক রাত হয়ে গেলো তো। সবাই ঘুমোচ্ছে আর তুমি পড়ছো৷ সারাদিনই পড়াশোনা করছো তোমার কি বিরক্ত লাগছে না?
‘ অনেক বিরক্ত লাগে ভাই। কিন্তু যখনই মায়ের কথা মনে পড়ে তখন সবকিছু ভুলে যাই। এটাই লাস্ট ইয়ার৷ অনেক ভালো পড়াশোনা করতে হবে৷ তারপর চাকরি পেতে হবে৷
আলিয়ান কাঁদতে কাঁদতে বলে, জানেন ভাই আমার মা তার হাতের বালা দুটো বিক্রি করে আমার জন্য টাকা পাঠিয়েছে৷ আমি কিভাবে তার অপচয় করতে পারি। ভাই পড়াশোনার জন্য আমার মা যা কষ্ট করেছেন সেই কথা ভেবে হলেও আমাকে সারাদিন পড়তে হবে৷ মা ঠিকমত খেতে পায়না আমার পড়াশোনার জন্য৷ আপনারা যখন ঘুরতে যাওয়ার জন্য বলেন না আমি যাইনা কেন জানেন ভাই? তখন আমার মায়ের মুখটা ভেসে ওঠে চোখের সামনে। আমাকে মায়ের স্বপ্ন পূরন করতে হবে। আমি ঘুরতে যেতে পারিনা৷ আমার প্রতিটা খরচ করার টাকার উপর আমার মায়ের ঘাম জুড়ে আছে। আমি সেই টাকা অযথা খরচ করতে পারিনা৷ আমি রেস্টুরেন্টে এর জন্য যাইনা আপনাদের সাথে। আমার মা লাস্ট কবে মাছ, মাংস খেয়েছে তা জানেনা আমি কিভাবে এসব খেতে পারি ভাই। বিশ্বাস করেন ভাই যদি না ঘুমানো লাগতো তাহলে আমি ২৪ ঘন্টাই পড়তাম৷ আমার মায়ের জন্য এটা করতাম।
আলিয়ানের কান্না শুনে সবাই জেগে গেলো। আলিয়ানের কথা শুনে সবার চোখেই পানি৷ সবাই আলিয়ানকে শান্ত করার চেষ্টা করছে।
‘ ভাই আমি চাকরি পেলে মায়ের স্বপ্ন পূরন হবে৷ যে করেই হোক আমাকে চাকরি পেতে হবে। দরকার হলে ২৪ ঘন্টাই পড়বো তাও ভালো রেজাল্ট করতে হবে৷
বড় ভাই আলিয়ানকে জড়িয়ে ধরে বললো, ভাই আমাদের ভবিষ্যৎ কিরকম হবে তা জানিনা৷ কিন্তু তুই ভালো কিছু করবি। তোর মায়ের দোয়া আছে তোর সাথে। তোর মা যে কষ্ট করে যাচ্ছে তার জন্য হলেও তুই চাকরি পাবি৷
আজকে আলিয়ানের রেজাল্ট দিলো। রেজাল্ট অনেক ভালোই হয়েছে৷ এখন ওর চিন্তা কিভাবে চাকরি পাওয়া যায়৷ আলিয়ান রেজাল্টের খবর দিতে ওর মায়ের কাছে আসলো৷ মাকে অসুস্থ লাগছে আলিয়ানের। অথচ ওকে কলে কিছু বলেনি৷ আলিয়ান ওর মাকে বলে, ডাক্তার দেখাওনি কেন তুমি?
‘ ও কিছুনা বাবা। সামান্য জ্ব’র এসেছে৷ তোর রেজাল্ট ভালো হয়েছে এতেই আমি অনেক খুশি৷
আলিয়ানের কাছে থাকা টাকা দিয়ে ওর মায়ের জন্য ঔষধ নিয়ে আসে৷ একদিন থেকে ওর মায়ের দোয়া নিয়ে আলিয়ান আসে। আসল পরিক্ষা ওকে এখন দিতে হবে৷ ওকে যে কোনো মূল্যে চাকরি পেতে হবে৷
আলিয়ান একটার পর একটা ইন্টারভিউ দিয়ে যাচ্ছে কিন্তু চাকরি হচ্ছেনা। ৩ দিন আগে একটা ইন্টারভিউ দিলো আবার আজকে একটা দিবে৷ হাতে থাকা পুরোনো বাটন মোবাইলটা সাইলেন্ট করে বাসায় রেখে তারপর সকাল সকাল বাসা থেকে বের হয়ে গেলো। জ্যামের জন্য পৌছাতে দেঁড়ি হবে তাই আলিয়ান অনেক সকালেই বাসা থেকে বের হয়েছে৷
খুব ভালোই পরিক্ষা দিয়েছে। যেমনটা আগের গুলো দিয়েছিলো। শুধু চাকরিটাই হচ্ছিলোনা৷ আলিয়ান জানেনা এটাও হবে কিনা।
বাহিরে এসে আলিয়ান দুটো সিঙারা আর পানি খেয়ে বাসায় আসলো। বাসায় মোবাইলটা বের করে দেখলো, অপরিচিত ৩০/৪০ টা নাম্বার থেকে ওকে লাগাতার কল দিচ্ছিলো৷ আলিয়ান কিছুটা অবাক হলো। এতগুলো নাম্বার থেকে ওকে কেন কেও কল দিবে৷ এটা ভাবতে ভাবতে আবার কল আসলো। আলিয়ান রিসিভ করার পরই অপর পাশ থেকে কেও একজন বললো, আমি তোমার মুনসুর চাচা তোমার মা অসুস্থ তোমাকে এখনই বাড়িতে আসতে হবে।
আলিয়ান তাড়াহুড়ো করে বাসা থেকে বেরিয়ে পরে। আলিয়ান খুব চিন্তিত কখন বাড়িতে যাবে ওর মাকে দেখবে৷ রাতেও মায়ের সাথে কথা হয়েছিলো৷ হালকা জ্বর ছিলো৷ আলিয়ান বলেছিলো কাউকে দিয়ে ঔষধ নিয়ে আসতে৷
আলিয়ান গাড়িতে উঠে পরলো৷ আজকে যেনো পথই শেষ হচ্ছে না। আলিয়ানের মোবাইলে আবার অপরিচিত নাম্বার থেকে কল আসলো। আলিয়ান রিসিভ করার পর জানতে পারলো, তিন দিন আগে যেখানে ইন্টারভিউ দিয়েছিলো সেখান থেকে কল দিয়েছে ওকে। আলিয়ান চাকরিটা পেয়ে গেছে৷ আলিয়ানের অনেক ভালো লাগছে৷ অবশেষে ওর মায়ের স্বপ্ন পূরন করতে পেরেছে৷ ওর মাকে গিয়ে প্রথমেই এই খুশির খবরটা দিবে।
আলিয়ান ওর বাড়ির একদম কাছাকাছি চলে এসেছে। বাড়ির সামনে অনেক লোকজন আছে৷ আলিয়ান কিছুই বুঝতে পারছেনা কি হচ্ছে এখানে৷ আলিয়ান আগের মতই দূর থেকেই ওর মাকে ডাক দিলো। কিন্তু আগের মত ওর মা সাড়া দিচ্ছেনা। আলিয়ান আবার ডাক দিলো কিন্তু তাও কোনো সাড়া শব্দ পাচ্ছেনা৷ এমনটা তো আগে কখনও হয়নি। এক ডাক দেওয়ার সাথে সাথেই ওর মা এসে জড়িয়ে ধরেছে তাহলে আজকে এত ডাক দিচ্ছে তাও মা কথা বলছেনা কেন!
আলিয়ান দেখতে পেলো বাড়ির সামনে থাকা সবার চোখেই পানি। আলিয়ান এবার চিৎকার করে ওর মাকে ডাক দিয়ে দৌড়ের ঘরের ভিতর গেলো৷ ভিতরে থাকা সবাই আলিয়ানকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বললো, বাবা তোমার মা আর বেঁ’চে নেই৷
আলিয়ান কথাটা শোনার সাথে সাথেই ওর মাকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে কাঁদতে লাগলো৷ আলিয়ান চিৎকার করে বলতে লাগলে, মা তুমি বলেছিলেনা আমাকে ভালো পড়াশোনা করে চাকরি পেতে হবে৷ দেখো মা আমি চাকরি পেয়েছি আজকে৷ কিন্তু তুমি থাকবেনা এটা তো কথা ছিলেনা। বলেছিলে সবসময় আমার সাথে থাকবে তাহলে এখন কেন আমাকে একা রেখে গেলে৷ আমি কান্না করলে তোমার খারাপ লাগে এখন যে কান্না করছি তা কি তুমি দেখতে পারছোনা৷ মা একবার আমার নাম ধরে ডাকো, একবার তোমার আচল দিয়ে আমার মাথা মুছে দাও মা। তুমি কথা না বললে কিন্তু আমি আর কখনও বাড়িতে আসবো না মা। এই মা কথা বলো তুমি। মা…..
আলিয়ানের কান্না দেখে সবাই কাঁদতে লাগলো৷ আলিয়ানকে থামানোর চেষ্টা করছে সবাই৷ কিন্তু কিছুতে কাজ হচ্ছেনা৷
লা’শ দাফনের জন্য নিয়ে যাওয়া হলো৷ আলিয়ান একদম চুপ হয়ে গেলো ওর মুখে কোনো কথা নেই৷ মনে হচ্ছে যেনো আলিয়ান একটা রোবটে পরিনত হয়েছে।
আলিয়ান ওর মায়ের ক’বরের সামনে পায়ের কাছে বসে আছে৷ কিছুখন পর পাশের বাড়ির এক চাচী এসে বললো, তোমার মা অনেক কষ্ট করেছে তোমার জন্য। তুমি যখন ছোট ছিলে তখন তোমার বাবা মা’রা যায়। তারপর থেকে তোমাকে মানুষ করার জন্য কষ্ট করে যাচ্ছে। আর শেষটাও সেই কষ্টেই কাঁটলো৷ তুমি আজকে সফল কিন্তু তোমার মা তা জানতে পারলো না। আজকে তুমি যা হয়েছে তার পিছনে রয়েছে তোমার মায়ের দোয়া আর পরিশ্রম। একদিন তোমার মা বলেছিলো, তার পরনের কাপড়টা অনেক জাগায় ছেঁ’ড়া। তোমার চাকরি হলে একটা নতুন কাপড় কিনবে।
আলিয়ান চোখের পানি মুছে ফেললো। ওর মা নিজের জী’বন দিয়ে দিলো ওকে সফল করতে।
আলিয়ান প্রথম মাসের বেতন পেয়ে ওর মায়ের বালা দুটো আর একটা শাঁড়ি হাতে কবরের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। ওর মাকে বলছে, দেখো মা তোমার বালা দুটো আমি ছাড়িয়ে নিয়ে এসেছি। তোমাকে আর ছেঁ’ড়া কাপড় পরতে হবেনা৷ একটা নতুন শাঁড়ি কিনেছি তোমার জন্য।
আজকে আলিয়ানের মা বেঁ’চে থাকলে হয়তো আনন্দে তার চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পরতো। সে যে দোয়া আলিয়ানের জন্য করে গিয়েছে তা সারাজীবন আলিয়ানের সফলতার চাবিকাঠি হয়ে থাকবে৷
আলিয়ান শাঁড়িটা পাশের বাসার ওর চাচীকে দিয়ে দিলো। ফিরে আসার আগে মায়ের দিকে তাকিয়ে বললো, মা তোমার বালা দুটো আমি ফিরিয়ে এনেছি৷