মুখ ও মুখোশের মাধ্যমে এদেশে চলচ্চিত্র নির্মাণ শুরু হয়। তবে হীরালাল সেনের চলচ্চিত্রই ছিল এদেশে প্রথম চলচ্চিত্র। ধীরে ধীরে এদেশের চলচ্চিত্র সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে। সৃজনশীল চলচ্চিত্র শুরু হয় এদেশে। এদেশের চলচ্চিত্র বিশ্ব দরবারে পৌঁছে যায়। কিন্তু এই চলচ্চিত্রের সাথে যারা জড়িয়ে আছেন তারা সবাই কি জীবনভর সমাজে মাথা উঁচু করে বাঁচতে পারেন? হোকনা সে আর্থিক বা সামাজিক?
আমি ১৯৭৭ সাল থেকে ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত এফডিসির সাথে ওতোপ্রতভাবে জড়িয়ে ছিলাম। আমি দেখেছি শেখ নিয়ামত আলী, আলমগীর কবির, কাজল আরেফিন, চাষী নজরুল ইসলামের মত চলচ্চিত্র পরিচালকদের কাজ। আমি দেখেছি রাজ্জাক, সোহেল রানা, ওয়াসিম, উজ্জ্বল, জাফর ইকবাল, আনোয়ার হোসেন, হাসান ইমাম, কবরী, শাবানা, ববিতা, সুচন্দা, সুমিতাদেবীদের মত অভিনেতা অভিনেত্রীদের কাজ। আমি দেখেছি চলচ্চিত্রের সহশিল্পী এবং পর্দার পেছনে যারা থাকেন তাদের কাজ। রঙ্গিন আলোর ঝলমলে স্থানে দাঁড়াতে কার না ভালো লাগে? গ্রাম থেকে এসে এই আলোক ঝলমলে স্থানে দাঁড়িয়ে খ্যাতি অর্জন করা কার না ইচ্ছে হয়? কিন্তু এই অর্জনের পর সেটাকে ধরে রাখাতো অনেক কষ্টের।
প্রতিদিন এফডিসি গেটের সামনে শত শত অভিনয় আগ্রহীদের ভিড় জমে। তাদের ভেতর থেকে দু’চারজন চলচ্চিত্রে অভিনয় করার সুযোগও পায়। শুধু অভিনয় না নায়ক-নায়িকা হওয়ার সুযোগ এসে যায়। কিন্তু অর্জিত অর্থ তারা ধরে রাখতে পারেন না। যার ফলে তাদের অনেকেই শেষ বয়সে অসম্ভব কষ্টের মাঝে জীবন যাপন করেন। তাদের ভেতরে আমি নায়িকা কবিতা ও নায়িকা বনশ্রীর কথা বলছি।
নায়িকা কবিতা সত্তর দশকের শেষ দিকে এবং আশির দশকের প্রথম দিকে চলচ্চিত্রে একক নায়ক হিসেবে অনেক ছবিতে কাজ করেছেন। ‘হাবা হাসমত’ তার অভিনীত ব্যবসার সফল একটি ছবির নাম। যার বিপরীতে অভিনয় করেছিলেন অত্যন্ত জনপ্রিয় কৌতুক অভিনেতা হাসমত। অত্যন্ত জনপ্রিয় কৌতুক শিল্পী এই চলচ্চিত্রটি লুফে নিয়েছিল দর্শক। অনেক চলচ্চিত্রে তিনি নিজকে উপস্থাপন করার সুযোগ পান। অনেক ভক্ত সৃষ্টি হয় তার। অনেক স্টেজ অনুষ্ঠানে তিনি অংশগ্রহণ করেন। সেসব অনুষ্ঠানে নায়িকা কবিতাকে দেখার জন্য দর্শক উপছে পড়ে। কিন্তু হঠাৎ একদিন পত্রিকায় দেখলাম একজন সাংবাদিক এই কবিতাকেই অসচ্ছল অবস্থায় পেয়েছেন ঢাকার পল্লবীর রূপনগর টিনশেড কলোনির মধু বাবুর বাড়িতে অভাব অনটনের মধ্যে করুণ অবস্থায় জীবন যাপন করছেন। টিনশেড বাড়িতেই হৃদ যন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে ৬০ বছর বয়সে ৮ই জুন তিনি মারা যান।
নায়িকা কবিতা পাকিস্তানের করাচিতে ৫২ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ষাট ও সত্তর দশকে জনপ্রিয় অভিনেত্রী ছিলেন। নায়িকা হিসেবে তিনি অভিনয় করেছেন ‘জংলি মেয়ে’, ‘ছোট সাহেব’, ‘চাঁদ ও চাঁদনী’, ‘স্বপ্ন দিয়ে ঘেরা’, ‘কে আসল কে নকল’, ‘ধন্যি মেয়ে’ সহ অসংখ্য ছবিতে। জনপ্রিয়তা থাকা অবস্থায়ই তিনি বিবাহ করেন চট্টগ্রামের ব্যবসায়ী চিত্র প্রযোজক ও বনানী চট্টগ্রাম প্রেক্ষাগৃহের মালিক গোলাম কবিরকে বিবাহ করেন। বিবাহ জীবনে তার দুই ছেলে ও এক মেয়ে। গোলাম কবিরের ঘর ছেড়ে এক সময় তিনি বেরিয়ে আসেন। পরবর্তীতে তিনি আরেকটি বিবাহ করেন। সে ঘরও টেকেনি। এক সময় তিনি অস্বচ্ছল অবস্থায় দিনাতিপাত করেছেন বস্তির একটি ভাঙা ঘরে।
নায়িকা কবিতার মত আরেক নায়িকার নাম বনশ্রী। ৯০ দশকে ইলিয়াস কাঞ্চনের বিপরীতে সোহরাব রুস্তম চলচ্চিত্রের মাধ্যমে সিনেমায় অভিষেক হয় চিত্রনায়িকা বনশ্রী। ১৯৯৬ সালে মুক্তি পায় বনশ্রী অভিনীত দ্বিতীয় সিনেমা মহা ভূমিকম্প। এই সিনেমায় দুই নায়ক মান্না ও আমিন খান। যাদের বিপরীতে অভিনয় করেছিলেন নায়িকা বনশ্রী। সেসময় নায়িকা বনশ্রী অনেক নায়কের সাথে অভিনয় করেন। জুঁটি বাঁধেন। তিনি কাজ করেছেন দশটি সিনেমায়। বিস্ময়কর হলেও এটাই সত্য। একসময় এই পর্দা কাঁপানো নায়িকা বনশ্রী অভাব অনটনে পড়ে ঢাকার শাহবাগে ফুল মার্কেটে ফুলের ব্যবসা করেছেন। বিভিন্ন বাসে হকারি করেছেন। নামাজ শিক্ষার বইও বাসে বাসে বিক্রি করেছেন। তীব্র অভাবের মধ্যে ঘানি টানতে না পেরে করোনা মহামারীর পর তিনি চলে আসেন নিজের উপজেলা শিবচরে।
এখন বাস করেন সরকারি প্রকল্পের ঘরে। মাদারীপুর শিবচর উপজেলার ইউনিয়নের প্রকল্পের একটি ঘরে থাকেন বনশ্রী। মানুষ বনশ্রী নামে চিনলেও তার আসল নাম সাহিনা শিকদার। শিবচর উপজেলার মাতবরের চর ইউনিয়নের সিকদারকান্তি গ্রামে তার বাড়ি। বাবা মজনু সিকদার ওরফে মুজিবুর রহমান সিকদার ঠিকাদারি করতেন। ব্যবসার কারণে তিনি পাড়ি জমান রাজধানীতে। তখন বনশ্রীর বয়স মাত্র সাত বছর। ধীরে ধীরে বনশ্রী বড় হয়ে ওঠেন এবং চলচ্চিত্রে প্রবেশ করেন। জনপ্রিয়তাও পান। তবে সুখের সময়টা বেশী দিন ছিল না।
চলচ্চিত্রে যারা অভিনয় করে দর্শকদের মন জয় করেছেন তাদের এ অবস্থা মেনে নেওয়া যায়?