দশ বছর পর আজ ঢাকা থেকে বাড়ি যাচ্ছি। আজ আমার পিচ্চিটার বিয়ে। অথচ গতকাল রাতেই জানতে পারলাম।তবুও যে এক ববন্ধু সাহায্যে জানতে পারছি এটাই অনেক। সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে কিছু কেনাকাটা করলাম। তারপর হানিফ কাউন্টারে গিয়ে দিনাজপুরের গাড়ির টিকেট কাটলাম। বিকেল তিনটায় গাড়ি। টিকেট কেটে বাসায় এসে খাওয়া করে কিছুক্ষণ রেস্ট নিয়ে পনের মিনিট আগে কাউন্টার এ গিয়ে পৌছালাম। গাড়িতে উঠে দেখি আর এক ঝামেলা। জানালার ধারের সিটের জন্য ১ ঘণ্টা পরের গাড়ির টিকেট কাটলাম সেই সিটে একটা মেয়ে বসে আছে। আমি গিয়ে মেয়েটাকে সুন্দরভাবে বললাম, আপনি যে জানালার ধারের সিটে বসে আছেন না, ওইটা আমার সিট। তখন মেয়েটি বলল, আসলে আমি যেখানেই যাই এই জানালার ধারের সিটেই বসি। কিন্তু আজ জানালার ধারের সিট পেলাম না। কিন্তু আমি এসে দেখলাম যে এই সিটে আপাতত কেউ বসে নি তাই বসে পড়েছি। তার জন্য সরি, তবে এই পাশের সিটটা আমার। আপনি যদি কিছু মনে না করেন তাহলে কি আমরা সিট টা একচেঞ্জ করে বসতে পারি? আসলে আমিও জানালার ধারের সিট ছাড়া দূরের কোথাও জার্নি করি নাতো, তাই জানলার ধারের সিট টা নিয়েছি।
মেয়েটা যেন কেমন চোখে আমার দিকে তাকালো, হয়তো ভাবছে আমাকে রিকুয়েস্ট করলো তবুও আমি তাকে সিটটা দিচ্ছি না। মুখটা গম্ভীর করে মেয়েটা উঠতে যাবে, তখনি আমি বললাম, আচ্ছা ঠিক আছে, আপনি আপাতত ওখানেই বসুন পরে না হয় কোন একসময় চেঞ্জ করে নেওয়া যাবে।
আমি আবার বললাম, আচ্ছা আপনিও তো দিনাজপুর যাচ্ছেন, এখানে কোথায় এসেছিলেন, চাকরি করেন বুঝি?
তখন বলল, না আমি এখানে চাকরি করি না, আমি এখানেই কোন এক পড়াশুনা করি ইকোনমিকস নিয়ে লাস্ট সেমিস্টার। আপনি?
আমি এখানেই একটা ছোটখাট চাকরি করি। আচ্ছা আমার পানি নেওয়া হয় নি, তাই পানি টা নিয়ে আসি।
কথাটি বলে আমি গাড়ি থেকে নেমে গেলাম, ২ প্যাকেট চিপ্স, জুস আর এক বোতল পানি নিয়ে মেয়েটার পাশে বসে পড়লাম।মেয়েটাকে একটা চিপসের প্যাকেট দিলাম। মেয়েটা ধন্যবাদ বললো। এক মিনিটের মধ্যে গাড়িটা চলতে শুরু করলো। আর কোন কথা হলো না মেয়েটার সাথে।
আমি সিটটা পেছন দিকে হেলিয়ে দিয়ে কানে এয়ারফোন গুজে চোখ বন্ধ করে নিলাম। হাল্কা সাউন্ড দিয়ে গান শুনছি, আর আত্মাটা কেমন জানি ধক ধক করছে। এয়ারফোন খুলে পকেটে রাখলাম, একটু পানি খেয়ে আবার সিটে হেলান দিলাম। কোন এক ঘোরের মধ্যে চলে গেলাম, ভাবতে লাগলাম আমার সেই পুরোনো স্মৃতি। আমি কেমন ছিলাম আর কিভাবেই বা এই ঢাকায় আসলাম। এসব ভাবতে ভাবতে ফিরে গেলাম ১২ বছর পূর্বে।
আমরা পাঁচ ভাই বোন। সবার বড় ভাই, তারপর দুই বোন, আমি চতুর্থ আর শেষে হলো আমার পিচ্চি বোন। বড় বোন দুটোর বিয়ে হয়ে গেছে। সে সময় আমি অষ্টম শ্রেণীতে পড়ি, আর আমার পিচ্চি আমার চার বছরের ছোট। সে ক্লাস ফোরে পড়ে। ছোটবেলা থেকেই আমরা দু’ভাই বোন খুব দুরন্ত, দুজনে মিলে বাড়িটা মাথায় তুলে রাখি। সবাই আমাদের অনেক আদরও করতো। আমার বোন যখন খুব ছোট ছিলো তখন মাঝে মাঝে কান্না করতো, ওর কান্না টা কেন জানি আমার মোটেই সহ্য হতো না। তার জন্য মাকে অনেক বকা বকি করতাম। এতে মা বিরক্ত হতে তাকে কোলে নিতো আর আমার পিচ্চি বোনটি চুপ করে যেতো। তখন কেমন জানি একটা শান্তি অনুভব করতাম। এরপর যতো দিন যায় আমার পিচ্ছি বোনটি কেমন জানি আমার নেওটা হয়ে গেলো। সবসময় আমার সাথেই থাকতো আমার পিচ্চি। শুধু খাওয়া ও ঘুমানোর সময় ও মার কাছে থাকতো।
যখন আমি ক্লাস এইট এ উঠলাম তখন কেমন জানি সবকিছু পরিবর্তনন হতে শুরু করলো।যেখানে আমি সারাদিন সবার সাথে দুষ্টুমি করলেও কেউ কিছুই মনে করতো না, এখন কেমন জানি সবাই রাগ করে। আমাকে অনেক বকাঝকা করে। মাঝে মাঝে গায়েও হাত তোলে। আমাকে যখন কেউ বকা দেয় বা মারে তখন আমি কান্না করি আর না করি আমাকে মারলে আমার পিচ্চি আমার আগেই কেদে দিতো। আমার পিচ্চি তো ছোট সে আর কি বুঝবে? তাই হয়তো না জেনে ভয়েই কেদে দিতো। এরপর দেখা যেতো তার কান্নায় বিরক্ত হয়ে তাকেও বকাঝকা করতো। যেদিন আমাকে মারতো বা বকাঝকা করতো সেদিন পিচ্চিটা এক মূহুর্তের জন্যও আমার কাছ ছাড়তো না।আমার সাথেই ঘুমাতো।
কিছুদিনের মধ্যে আমার ভাইয়ার বিয়ে হয়। বাড়িতে নতুন ভাবি এলো।সে আমাদের অনেক আদর করে। এতে আমাদের বকাঝকা কমে আসে। আমরাও কিছুটা পূর্বের দিনে ফিরে আসি। আবার আনন্দে মেতে থাকি। হাসি, ঠাট্টা তামাশা, ফাজলামি করি। কিছুটা শান্তি ফিরে আসে আমাদের মনে।
কিন্তু এক বছর যেতে না যেতেই আবার আগের অবস্থায় ফিরে আসে। আমাদের দুষ্টুমি গুলো আর কারও সহ্য হয় না।আমার পিচ্চি ক্লাস ফাইভ এ, সে ছোট তাই তাকে তেমন কিছু বলা হতো না। সব ঝড় যেতো আমার উপর দিয়েই। সবাই বলতো যেমন ভাই তেমন বোন। যে কারনেই একটু অশান্তি সৃষ্টি হলেই আমার উপর সবার নজর পড়তো। আমার দোষ থাকলেও আমাকে বকতো না থাকলেও আমাকে বকতো। আমি হয়ে গেছি সবার দু’চোখের বিষ। কোন কিছু হলেই বলতো সব দোষ দ্বীপের। নিজে তো ভাল হবে না বোনটাকেও ভাল হতে দিবে না। নিজে তো কোন আদবকায়দা শিখে নি, আর বোনটাকেও বানাচ্ছে তার মতো।
যেদিন বকাঝকা শুনে চুপ করে থাকতাম সেদিন শুধু বকা দিয়েই শান্ত থাকতো, আর যেদিন আমি কিছু বলতাম সেদিন কপালে মাইর জুটত। আগে গালি দিতো বাবা, মা, ভাইয়া আর এখন ভাবিও যুক্ত হয়েছে।
আমরা অনেক দুষ্টু হলেও লেখাপড়ায় অনেক ভাল ছিলাম। আমি ছিলাম ক্লাসেএ ফার্স্ট বয়। তাই ক্লাস নাইন এ উঠে আমি সাইন্স নিলাম। আমার পিচ্চি এবার ক্লাস ফাইভে। সেও পড়ালেখায় খুব ই ভাল। এখন পর্যন্ত তাকে কেউ কাটাতে পারে নি। আমি নাইন এ উঠে সাইন্স নেওয়াতে আমার পিচ্চিটা অনেক খুশি। কে যেন তাকে বলেছে ডাক্তার হতে হলে সাইন্স নিয়ে পড়তে হয়। সে একদিন স্কুল থেকে আসার সময় হোচট খেয়ে পড়ে পায়ে ব্যথা পায়। সে কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি এসে সোজা আমার কাছে আসে। বলে দাদা ভাই তুই একদিন ডাক্তার হবি আর আমার ব্যথা লাগলে সারিয়ে দিবি। আমি তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে আসতে করে একটা হাসি দেই। তারপর তার পায়ে মুভ স্প্রে করে দেই।
একদিন দেখলাম আমার পিচ্চি একটা পেয়ারা দাত দিয়ে ছিলে ফেলেছে এখন খাবে। ওর এটা একটা অভ্যাস। পেয়ারার কোসা কখনওই খায় না।আমি দৌড়ে রান্নাঘরে গেলাম। সেখান থেকে ভালদেখে আরও দুইটা পেয়ারা নিয়ে আসলাম। এসে বোনকে বললাম, দেখতো এই পেয়ারা দুইটা ভাল না খারাপ? ও বলে ভালো। আমি সাথে সাথে ওর হাত থেকে পেয়ারাটা নিয়ে একটা কামড় দিলাম। বললাম তুই ওই দুইটা খা আমি এটা খাবো।
আমি কামড় দেওয়ার সাথে সাথে সে মা বলে চিল্লানি দিলো আর কান্নার ভান করতে লাগলো। মা আসলো, এসে দেখে আমি তার ছিলানো পেয়ারাটা খাচ্ছি। এই পিচ্চি আবার এটার জন্য মার কাছে নালিশ করলো। মা সাথে সাথে আমাকে টেনে একটা থাপ্পড় দিলো। এতোই জোড়ে মারছিলো যে হাতের চারটা আঙুল আমার গালে বসে গেছিলো।
মা আমাকে থাপ্পড় মেরে আরও অনেক কথা শুনিয়ে দিলো। সবচেয়ে যে কথাটা খারাপ লাগলো, তুই নিজেও শান্ত থাকবি না আর কাউকেই শান্তিতে থাকতে দিবি না। ভালভাবে থাকতে পারলে থাক, আর না পারলে তুই মরে যাচ্ছিস না কেন। দুষ্টু গরুর চেয়ে শূন্য গোয়াল অনেক ভাল।
মায়ের বকুনি আর মাইরের সাথে আমি আগে থেকেই পরিচিত। কিন্তু আজ মা সামান্য একটা পেয়ারার বেপারের জন্য আমাকে মরতে বললো। মাইরের আঘাতে যতটা না কষ্ট পেয়েছি, তার চেয়ে বেশি কষ্ট পেয়েছি এই কথা টাতে।
এদিকে আমি ওর পেয়ারা খেয়েছি বলে এতোক্ষন কান্নার অভিনয় করছিলো, কিন্তু যখন মা আমাকে থাপ্পড় মারলো আর বকাঝকা করলো তখন দেখি তার কান্না থেমে গেছে, কিন্তু তার চোখ দিয়ে জল পড়ছে। আমি ওর দিকে একবার তাকালাম। দেখি অপরাধীর মতো আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি ওর পেয়ারাটা আবার ওর হাতে দিয়ে আমি আমার রুমে চলে আসলাম।এসে দরজা লাগিয়ে শুয়ে পড়লাম। রাতে বোনটি আমার ডাকছে।
– দাদা ভাই, এই দাদা ভাই , উঠ না!! তুই খাবি না??
-,,,,,,, (চুপ)
– দাদা ভাই,এই দাদা ভাই, উঠ তাড়াতাড়ি। সবার খাওয়া হয়ে গেছে, শুধু তুই আর আমি আছি।
– আমি খাবোনা, তুই খেয়ে শুয়ে পড়। দড়জা না খুলেই বললাম।
– তুই না খাইলে আমিও খাবো না। আমার কিন্তু খুব খুদা লাগছে। দরজার ওইপাশ থেকে বোন বলল।
আমি একটু অবাক হলাম। বলে কি এই পিচ্চি?? যেখানে বাড়ির কেউ আমার একটা খবরও নিলো না, সেখানে এই পিচ্চি বলছে আমি না খেলে নাকি সে খাবে না।
আমি জানি, পিচ্চি বোন আমার ক্ষুদা সহ্য করে থাকতে পারে না। ও সারা দিনে কয়বার যে খায় সে নিজেও জানে না। তাই উঠে দরজা খুললাম। দেখি বোন আমার হাতে করে খাবারের প্লেট নিয়ে দারিয়ে আছে। নিমেষেই আমার চোখ জলে ভরে উঠলো। পিচ্ছি আমার দিকে একবার তাকিয়ে রুমে ঢুকে পড়লো। বললো, যা হাতমুখ ধুয়ে আয়। আমি ফ্রেশ হয়ে এসে খাটে বসলাম। বোন বললো হা কর। আমি তাই করলাম। বোনটি আমার পরম মমতায় আমাকে খাইয়ে দিতে লাগলো। কেন জানি আমার চোখে জল এসে গেলো।
বোনকে বললাম তুই খাবি না? ও বললো তুই আগে খা তারপর আমি খাবো। আমি ওর হাত থেকে খাবারের প্লেট টা নিয়ে ওকে বললাম নে তুইও খা। ও সাথে সাথে কেদে দিলো। আমি ওকে খাইয়ে দিলাম। আমি বললাম কাদছিস কেন পাগলি। ও বললো আমি তো মিছামিছি কান্নার ভান করছিলাম তখন আর মা তোকে মার দিলো। মা মারবে জানলে আমি কখনওই মাকে ডাকতাম না। আমি বললাম আমি জানি। আমরা দুজনেই খাওয়া করে আমার রুমেই শুয়ে পড়লাম।
এখন আমি অনেক শান্ত, আগের মতো দুষ্টুমি আর করি না। বাড়ির কারও সাথে তেমন কথা বলি না। সারাদিন শুধু পড়া নিয়ে বসে থাকি, আর যা খুনসুটি করি সব আমার পিচ্চির সাথে। আমি ওর সাথে যাই করি না কেন, সেদিনের পর থেকে আর কারও কাছে আমার নামে কোন অভিযোগ করেনি। এভাবেই যায় আমার দিন। একা একা।
এক বছর পর, এই পৃথিবীতে আসে আসে আরও একটি নতুন প্রাণ। আমার ভাই ও ভাবির কোল আলো করে আসে ছোট্ট বাবু। দেখতে অনেক কিউট হয়েছে। তখন সবার মুখেই হাসি। আমার মুখেও। পরিবারের সবাই আনন্দিত।
এবার আমি ক্লাস টেনে, আর আমার পিচ্চি সিক্স এ। আমি এস এস সি প্রিপারেশন নিচ্ছি। একদিন ছোট্ট বাবুটাকে কোলে নিয়ে হাটছিলাম। আমার বোনও সাথে ছিলো। আমার বোন বাবুর হাত ধরে খেলা করছিলো, কখনো কখনো গাল টেনে দিচ্ছিলো। এতে বাচ্চাটি কান্না শুরু করে দেয়। আমার আবার বাচ্চার কান্না একবারেই সহ্য হয় না। অনেক চেষ্টা করি বাবুর কান্না থামানোর কিন্তু কান্না থামছেই না। তাই দৌড়ে তার মায়ের কাছে নিয়ে যাচ্ছিলাম। তখনি বিপত্তিটা ঘটলো। আমি হোচট খেয়ে পড়ে গেলাম, কিন্তু বাবুকে কোন আঘাত পেতে দেই নি। কারও পড়ে যাওয়ার শব্দ শুনে বাবুর মা ছুটে আসে। এসে দেখে আমি পড়ে গেছি আর বাচ্চা টা আমার কাছেই আছে। আমি পড়ে যাওয়াতে বাবুও কেন জানি চুপ হয়ে গেলো। কিন্তু আমাদের ঐ অবস্থায় দেখে বাবুর মা বাবুকে আমার কাছ থেকে টেনে নিয়ে আমার গালে ঠাসস,,, করে একটি চড় বসিয়ে দেয়। অনেক বকাঝকা শুরু করে। মরনও হয় না তোর, কোলে নিতে না পারলে নিস কেন। আমার মা সব শুনতেই পাচ্ছে তবুও কিছুই বলে না। ভাবি শুধু তার ছেলের কথাই ভাবলো, আমার কথা একটুও ভাবলো না। আমি ব্যথা পেয়েছি কিনা সেদিকে তার কোন খেয়াল নেই। আমি যে পড়ে গিয়ে আমার চিবুক কেটে গিয়ে রক্ত পড়ছে সেটাতে তার কিছুই যায় আসে না। সে বকতে বকতে চলে গেলো। আমি উঠে সোজা আমার রুমে চলে গেলাম। ওয়াসরুমে গিয়ে হাতমুখ ধুয়ে বের হলাম, দেখি বোন স্যাভলন এর বোতল হাতে দারিয়ে আছে। পিচ্চি স্যাভলন লাগিয়ে দিলো। আবার বললো মুভ স্প্রে করে দেই। আমি একটু হেসে বললাম ধুর পাগলি, মুভ স্প্রে করলে আরও বেশি জলবে। ও বললো আচ্ছা তাহলে থাক। এভাবেই দিন যাচ্ছিলো আমাদের। প্রতিনিয়ত আমাকে সবার বকা শুনতে হয়। এতো কথা শুনতে আমার আর মোটেই ভাল লাগছে না। কথায় কথায় সবার এক কথা, তুই মরিস না কেন? সবাই আমাকে মরতে বলে। মাঝে মাঝে মনে হয় সত্যি সত্যি মরে যাই। কিন্তু আমার পিচ্চির দিকে তাকালে আমার আর কোন কষ্ট থাকে না। অনেক মায়াভরা মুখ তার। ওর দিকে তাকিয়ে আমি হাজার কষ্টও সহ্য করতে পারি। তবে তখনি খারাপ লাগে যখন আমার কষ্ট দেখে পিচ্চি টা কেঁদে কেঁদে চোখ ফুলিয়ে ফেলে।
কয়েকদিন পর বাবুর আকিকা, তার নতুন নাম দেওয়া হবে। আর সাথে আমার পরিক্ষা। ঠিক আমার পরিক্ষার সময়ই বাবুর আকিকা পড়ে। এদিকে অনুষ্ঠান আর একদিকে আমার পরিক্ষা। অনুষ্ঠান শুরু হয়ে গেলো, আমার পরিক্ষা নিয়ে কারও কোন যায় আসে না। মাঝে মাঝে দেখছি বোন আমার রুমে উকি দিচ্ছে। যেদিন অনুষ্ঠান সেদিনও আমার পরিক্ষা ছিলো। তার পরের দিনও আছে। বাড়িতে অনেক আত্মীয় এসেছে আমার দুই বোন এসেছে। তারা একবার করে এসে আমার সাথে দেখা করে গেছে। আমার পরিক্ষা শুনে আমাকে ভালকরে পড়তে বলে সেখান থেকে চলে গেছে। সারা বাড়িটাই হই হুল্লোর এ মুখরিত। শুধু একটি রুমে দরজা বন্ধ করে আমি বই পড়ছি। আমারও অনেক ইচ্ছা করছে বাইরে গিয়ে আমিও আনন্দ করি। সাথে আবার ভয়ও কাজ করছে যদি ভুল কিছু করে ফেলি, আর সবার সামনেই যদি আমাকে মারে। বাড়ির লোকের কাছে অপমান সহ্য হলেও অন্যকারো সামনে অপমান সহ্য করতে পারবো না। তাই আর বাইরে গেলাম না। তাছাড়া পরদিনেই তো আমার পরিক্ষা। পড়াও তো দরকার। অনুষ্ঠান মিটে গেলো পরের দিনেই। সবাই বাড়ি চলে গেলো। শুধু ভাবির বোন নূরীকে দেখলাম। সে নাকি কয়েক দিন পরে যাবে। নূরী আর বোন আবার একই ক্লাসে পড়ে। তাই পড়ার বই নিয়ে কোন টেনশন নাই। তাই সে থেকে গেলো। তারা দুজনেই এবার ক্লাস সেভেনে।
একদিন হয়েছে কি,, আমি রুমে বসে বই পড়ছিলাম। আমার আর একটা মাত্র লিখিতো পরীক্ষা বাকি আছে, তারপর প্রাক্টিক্যাল পরিক্ষা। তখন বোন আর নূরী আমার রুমে ঢুকলো।বোন বললো দাদাভাই লুডু খেলবি?? বললাম নিয়ে আয়। বোন লুডু নিয়ে আসলো। আমরা তিনজনে অনেক মজা করে লুডু খেলছি আর হাসি ঠাট্টাতামাসা করছি। এভাবে হাসতে হাসতে ফাজলামি করে আমি নূরীকে বললাম, নূরী অনেক তো বড় হয়ে গেলি, চল এবার বিয়েটা করে ফেলি। আমার ভাই তোর বোনকে আর আমি তোকে। কেমন হবে বল তো?? আর তুই দিন দিন যা দেখতে হচ্ছিস। এক্কেবারে ফুলটুসি,,,,। আমার কথা শুনে বোন ও নূরী দুজনেই হাসছে। নূরী বললো,,, আগে আরও বড় হই তারপর। এখনো আমি অনেক ছোট, বলেই আবার হাসতে শুরু করলো। কিন্তু আমাদের সবার এই হাসিটা বেশিক্ষন আর স্থায়ী হলো না। কারণ কথা গুলো তাদের সাথে সাথে আমার ভাবিও শুনে ফেলেছিলো।
এতে ভাবি অনেক রাগ করে। সে এসে আমার দুই গালে দুইটা ঠাস ঠাস করে মেরে দেয়। বোন ও নূরী দুইজনেই অবাক। তখন ভাবি বকতে বকতে নূরীর হাত ধরে টেনে নিয়ে চলে যায়।
তখন যেটা হয়েছিলো সেটা সহ্য করে নিয়েছিলাম। কিন্তু রাতে যেটা হলো সেটা সহ্য করার মতো না। ভাই ওর অফিস থেকে বাসায় আসে। আসার কিছুক্ষন পর ভাই ফ্রেশ না হয়েই আমার রুমে আসে। এসে আমার হাত ধরে আমাকে টেনে চর মারতে মারতে রুম থেকে আমাকে টেনে বের করে। সেখানে সবাই ছিলো তখন। আমার পিচ্চি ও নূরীও ছিলো। ওখানেই সবার সামনে ভাই তার কোমর থেকে বেল্ট খুলে আমাকে মারা শুরু করে। সেই সাথে বকতে থাকে এই বয়সেই খারাপ হয়ে গেছিস? এতো বাজে ব্যবহার তোর? অইটুকু মেয়ের সাথে তুই খাপার কাজ করিস। জীবনে কোনদিনও এতো মাইর খাইনি। ভাইয়ার ভীষণ কথা শুনে বুঝতে পারলাম ভাবি ভাইয়াকে অনেক কিছু বানিয়ে বলেছে। এদিকে আমার চিৎকার শুনে আমার পিচ্চি আর নূরী দুজনেই কেঁদে ফেলেছে। এসব কথা শুনার পর সত্য মিথ্যা যাচাই না করে আমার বাবা মাও তার মাইর এ সায় দেয়, সেই সাথে আমাকে আরও বেশি করে বকতে থাকে। আর শুনলাম বলছে, কোন পাপের ফলে যে এরকম একটা ছেলে জন্ম দিয়েছি যে ভগবানই জানে। এইটা মরে না কেন, এইটা মরলেই তো আমরা একটু শান্তি পাই। এর পরদিন থেকে আমি আর কারও সামনে যাই না। শুধু পরিক্ষা দেওয়ার সময় রুমথেকে বের হয়ে পরিক্ষা দিতে যাই, আবার সিয়ে ফিরে এসে সরাসরি আমার রুমে ঢুকি। আর খাওয়া দাওয়াটা আমার পিচ্চিই সময় মতো করাই দেয়। দশ দিন হয়ে গেলো আমার পিচ্চিকে ছাড়া আর কাউকেই দেখিনি। আর তারাও আমার রুমে কখনও আসে নি। আর আমিও তাদেরকে আমার দরকার পড়লেও ডাকিনি। শুধু মনে মনে শক্তি সঞ্চয় করে আমার পরিকল্পনা আঁকছি।
…
চলবে………??