‘কিরে আপা তুই আম্মা আব্বার জন্য কোন উপহার আনিস নি? ঈদের মধ্যেও খালি হাতেই চলে এলি?
পায়রার কথায় লজ্জায় আমার মাথা কাটা যাচ্ছে। বাড়ির সবগুলো মানুষের সামনে পায়রা আমায় এমন একটা লজ্জাজনক কথা বলবে আমি ভাবতে পারি নি।
‘দুলাভাইয়ের তো চাকরি নেই পায়রা। তাই আপা হয়তো কিছু দিতে পারে নি। চুপ থাক না তুই।’
সায়রার কথায় আরো বেশি লজ্জায় পড়ে গেলাম। এক পলক রেদওয়ানের দিকে তাকাতেই দেখলাম সেও মাথা নিচু করে আছে। ঈদে বাপের বাড়িতে এসে এতো লজ্জাজনক পরিস্থিতিতে পড়বো ভাবতে পারি নি। পায়রার স্বামী আমাদের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসছে। এটা আমাকে আরো লজ্জা দিচ্ছে। এ বাড়ির বড় মেয়ে হয়ে বাবা মায়ের জন্য ঈদের উপহার আনতে পারি নি। ছোট দুইবোন মা বাবার জন্য হাত বোঝাই উপহার নিয়ে এসেছে।
আমার স্বামীর চাকরি নেই। ছয় মাস হলো রেদোয়ানের চাকরি নেই। যেই কোম্পানিতে রেদোয়ান চাকরি করতো সরকার থেকে তা বন্ধ হয়ে গেছে। তাই রেদওয়ানের চাকরিটাও চলে গেছে। রেদোয়ান চাকরি যোগারের অনেক চেষ্টা করেও চাকরি পায় নি।এদেশে তো একবার চাকরি গেলে দ্বিতীয় চাকরি পেতে দম ফুরোয়। রেদওয়ানের চাকরি যাওয়ার পরই আমার চারপাশটা বদলাতে শুরু করে। শাশুড়ি কথা শুনায়, ননদ কথা শুনায়। জা রাও এখন আর ছাড় দেয় না। প্রতিটা বেলায় খোঁটা দেওয়ার কথা তারা মোটেও ভুলে না। আগে যা সম্মান পেতাম তার ছিটেফোঁটাও এখন পাই না। সবকিছুই মেনে নিয়েছি আমি। স্বামীর চাকরি না থাকলে এটা স্বাভাবিক এখানে অস্বাভাবিক কিছুই নেই।
কিন্তু গতকালই আমার শাশুড়ি বলেছে, যেই ছেলে সংসারে একটা টাকাও খরচ করতে পারে না সেই ছেলে যেন বউকে নিয়ে কুরবানীর গোশত খেতে এ বাড়িতে বসে না থাকে। নিজের খরচ সাথে বউয়েরও খরচ। আমার ছেলেদের অন্ন ধ্বংস করছিস। আমার বাকি দুই ছেলে কি তোদের জন্য নিঃস্ব হবে নাকি?
শাশুড়ির এই কথাটা খুব গায়ে লেগেছিলো। ঈদের দিন শাশুড়ির কাছ থেকে এমন কথা শুনবো কখনো ভাবি নি। রেদওয়ান তার দুই ছেলের অন্ন ধ্বংস করছে? ঈদের সময় এতো বড় কথা তার মনে খুব দাগ কেটেছে। কিন্তু আমার অশ্রু বিসর্জন দেওয়া ছাড়া কোন উপায় ছিলো না। ও বাড়িতে খোঁটা শুনে এসেছি স্বামীর চাকরি নেই বলে। কিন্তু স্বামীর চাকরি না থাকলে বাঙালি বধূদের যা করতে হয় তাই তো করছি আমি। গাধার মতো কাজ করে তো তা পুষিয়ে দিচ্ছি, এতেও তাদের খুশি রাখতে পারি না। নিয়তি আমাকে এখানে এনে দাঁড় করিয়েছে।
সারাদিনের ক্লান্তি শেষে গতকাল রাতে মাকে ফোন করেছিলাম। মায়ের কাছ থেকে শুনেছিলাম আমার ছোট দুইবোন বেড়াতে আসবে। খুব খুশি হয়েছিলাম ভাবলাম বোনদের সাথে একসাথে বেড়াবো। এখানে তো এমনিতেও কোন পাত্তা নেই আমার। কিছুদিন বোনদের সাথে বাবার বাড়িতে ঘুরে আসলে ভালো লাগবে। তাই রেদওয়ানের সাথে জেদ ধরে বাপের বাড়িতে এসেছি। শাশুড়ি বহুবার নাক ছিটকেছে কিন্তু পাত্তা দেই নি। নিয়তির কথা স্মরণ করতেই জলে চোখ টইটুম্বর হয়ে গেলো।
এ বাড়িতে আমি সবার আগেই এসেছি। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর একে একে পায়রা এরপর সায়রা এসেছে। কি যে ভালো লেগেছে বোনদের দেখে বলে বোঝাতে পারবো না। কিন্তু আসার পরই ওরা দুইবোন মা বাবার জন্য তাদের আনা উপহার মা বাবাকে দিচ্ছে। খুব দামী দামী উপহার এনেছে। বাবার জন্য পাঞ্জাবি, পায়জামা, লুঙ্গি, টুপি, জুতা, আতর। মায়ের জন্য শাড়ি, ব্লাউজ, পেটিকোট পিছ, চুরি জুতো। বেশ ভালোই। উপহার দেওয়ার মাঝেই পায়রা ওমন একটা কথা বললো। লজ্জায় আর তাকাতে পারছি না। রেদওয়ানও যে খুব বিব্রত বোধ করছে এটা বুঝতে পারলাম। এ বাড়ির বড় জামাই যে। নিশ্চয়ই এটা তার জন্য লজ্জাজনক। আমরা দুজনেই লজ্জায় মাথা নিচু করে আছি।
‘তোরা যা এনেছিস তা দে। ওদেরটা ওদের বুঝতে দে।’ বাবার ধমকের সুর। পায়রা বাবার কথা শুনে মুখ ভেংচালো। রেদওয়ান আস্তে উঠে বাহিরে চলে গেলো। এখানে বসে লজ্জা পাওয়ার চেয়ে চলে যাওয়াই উত্তম। আমি আর কিছু বললাম না। ওরা নিজেদের আনা উপহারগুলো বাবা মায়ের হাতে বুঝিয়ে দিলো। এরপর সেখান থেকে নিজেদের ঘরে যেতেই দেখতে পেলাম পায়রার ননদ আর ননদের স্বামী আমাদের ঘরে শুয়ে আছে। আমাকে দেখে পায়রার ননদ বললো,
‘আপনি দরজায় কড়া দিয়ে প্রবেশ করলেন না কেন? স্বামী স্ত্রীর ঘরে কেউ এভাবে প্রবেশ করে? নূন্যতম ম্যানার্সও কি আপনার মাঝে নেই?’
ওনার কথা শুনে অবাক হলাম। একে তো আমার ঘরে শুয়ে আছে উল্টো আমাকেই কথা শোনাচ্ছে। রাগ হলো প্রচুর। বললাম, আমার রুমে আমি নক করে কেন আসবো? আপনারা আমার রুমে কি করেন?
তো আমি কখন বললাম এটা আমার রুম? এখানে এখন আমাদের থাকতে দেওয়া হয়েছে। আর আপনি আমার সাথে এভাবে রেগে কথা বলছেন কেন? আপনাদের বাড়িতে বেড়াতে এসেছি কোথায় আদর যত্ন করবেন কিন্তু তা না করে অপমান করছেন! মেহমানদের সাথে কেউ এমন ব্যবহার করে? ভাবীকে আগেই বলেছিলাম আমি আসবো না জোর করে এনেছে এভাবে অপমান করার জন্য।
আমি আর তার সাথে কথা বড়ালাম না। সেখান থেকে চলে আসলাম। উঠানে রেদোয়ানকে মামার সাথে দাঁড়িয়ে কথা বলতে দেখলাম। সেদিকে একবার নজর দিয়ে সোজা মায়ের কাছে গেলাম। বললাম,
‘মা আমাদের শোবার ঘরটায় পায়রার ননদ কি করছে?’
আমার কথায় মা চমকে উঠলেন। আমতা আমতা করে বললেন, এবার পায়রা ওর ননদ আর তার জামাই নিয়া বেড়াতে আসছে। বাড়িতে তো ঘর চাইরটা। সায়রার ঘরে সায়রা আর ওর ঘরে ওয় আর তোরটায়…
‘ওর ননদ তাই তো? আমার ঘরে ওর ননদ কেন থাকবে?
ওরা ওখানে থাকলে আমরা কোথায় থাকবো?’
মা আবার আমতা আমতা শুরু করলেন। বললেন, ‘তোরা আমগো আগের পুরান ঘরটায় এবার থাক। আমি সব গোছায়া দিমু। আমি আর কি করতে পারমু ক মা?
ভীষণ অবাক হলাম। মা আমাকে সেই পুরানো ঘরটায় থাকতে বলছে। যেটার অর্ধেক টিনই ক্ষয় হয়ে গেছে। একদম নাজেহাল অবস্থা। তৎক্ষণাৎ চোখদুটো জলে টইটুম্বর হয়ে গেলো। মায়ের সাথে কথা না বাড়িয়ে লাভ নেই কারণ মা কিছুই করবেন না এটা বেশ ভালো বুঝেছি। তাই উঠানে রেদোয়ানের কাছে গেলাম। সে উঠানে একা দাঁড়িয়ে আছে। আমার মলিন মুখ দেখে রেদোয়ান বললো,
কি হয়েছে আয়ু? এভাবে মুখ গোমড়া করে রেখেছো কেন?
আমার চোখ থেকে তৎক্ষণাৎ জল গড়িয়ে পড়ছে। বললো, তোমাকে এখানে এনে খুব অসম্মান করেছি আমি তাই না?
রেদোয়ান হাসলো। বললো, বাড়িতেই বা কিসের সম্মান পাই আমি?
ওর কথায় ভীষণ কষ্ট হলো আমার। বললাম, আমাদের এবার পুরানো ঘরটায় থাকতে হবে রেদোয়ান।
রেদোয়ান বিস্মিত হলো। কিন্তু মুখে কিছুই বললো না। আমি বুঝতে পেরেও চুপ থাকলাম। কিছু বলার সাহস পেলাম না। ঘর থেকে জামা কাপড়ের ব্যাগটা নিয়ে পুরানো ঘরটার দিকে গেলাম। ঘরের এক কোণায় একটা ছোট্ট খাট। পাশে একটা টেবিল তার উপর এক জগ পানি আর একটা গ্লাস। এপাশে একটা আলনা। রেদোয়ান ঘরে ঢুকেই জগ থেকে পানি নিয়ে পান করলো। এরপর ধপাস করে খাটের উপর বসে পড়লো রেদোয়ান। মাথার উপর তাকিয়ে ফ্যানের সন্ধান করলো সে।
মাথা নাড়িয়ে না জানালাম। এরপর টেবিলের উপর থেকে হাতপাখা নিয়ে রেদোয়ানকে বাতাস করতে লাগলাম। সাথে সাথে নিজের চোখের জলও বিসর্জন দিতে লাগলাম। এখানে এসেও একই পরিস্থিতিতে পড়বো ভাবতেই পারি নি আমি। নিয়তির পরিণতির কথা ভাবতেই শরীর শিউরে উঠলো আমার।
হঠাৎই পায়রার চিৎকার চেঁচামেচিতে ঘর থেকে বের হয়ে আসলাম। ব্যাগপত্র হাতে নিয়ে পায়রা মায়ের সাথে কথা বলছে। তার ননদের সাথে আমার ব্যবহার নিয়ে কি যেন বলছে ও। সাথে বাড়িতে থাকবে নাও বলছে। ওর ননদ, তার স্বামী এবং পায়রার স্বামী এক পাশে দাঁড়িয়ে আছে। ওর ননদ আমাকে দেখেই মুখ ভেংচি দিলো। ভীষণ অবাক হলাম আমি। ওদের কাছে যেতেই পায়রা মাকে বললো, এই যে তোমার বড় মেয়ে চলে এসেছে। ওকে বলো এক্ষুনি আমার ননদের কাছে ক্ষমা চাইতে। নাহলে আর এক মুহূর্তও আমি এই বাড়িতে থাকবো না!
ওর এমন ব্যবহার আমি স্বপ্নেও আশা করি নি। ওর কথা শুনে মনে হচ্ছে আমার পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে যাচ্ছে…..