সুমাইয়া আক্তার সিমু (২০)। দুই বছর আগে বিয়ে হয়েছে। তার প্রথম সন্তান সুয়াইবা। বয়স মাত্র আড়াই মাস। দুই মাস ধরে নবজাতককে নিয়ে মায়ের বাসায় বেড়াচ্ছেন। ২৭শে জুলাই শ্বশুরবাড়ি কুমিল্লায় যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ২১শে জুলাই বাদ আসর বাচ্চাকে ঘুম পাড়িয়ে বারান্দায় যায় সুমি। সেখানে আগে থেকেই তার মা আছমা বেগম দাঁড়িয়েছিলেন। হঠাৎ একটি গুলি এসে সিমুর মাথায় লাগে। মুহূর্তেই লুটিয়ে পড়ে সে। মেয়েকে পড়ে যেতে দেখে দৌড়ে এসে মা আছমা বেগম বলে উঠেন ও মা, ও মা কি হয়েছে। কিন্তু কোনো সাড়া-শব্দ নেই। রক্তে ভেসে যাচ্ছে ফ্লোর। চোখের পলকে সুমির নিথর দেহ জানান দেয় সে আর নেই। চিরদিনের জন্য পৃথিবীর মায়া ছেড়ে গেছে। মাকে মা বলে ডাকার আগেই মা-হারা হয়ে যায় তার আড়াই মাসের সুয়াইবা। সিমুও তার আদরের সন্তানের মুখে মা ডাক শুনতে পারলেন না। নির্মম ঘটনাটি ঘটেছে কোটা সংস্কার আন্দোলন চলাকালে নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জের পাইনাদী নতুন মহল্লা দোয়েল চত্বর এলাকায়। ওইদিন সকাল থেকেই ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সিদ্ধিরগঞ্জের শিমরাইল মোড় থেকে সাইনবোর্ড পর্যন্ত সড়ক জুড়ে কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংঘাত চলছিল। সারাদিন টিয়ারশেল, গুলি ও সাউন্ড গ্রেনেডের বিকট শব্দে আতঙ্ক বিরাজ করছিল সর্বত্র।
নিহতের মা আছমা বেগম জানান, আর্থিক সংকটের মধ্যে করোনার সময় তার স্বামী সেলিম মাদবর মারা যান। ৩ ছেলে ও দুই মেয়েকে নিয়ে নিরুপায় হয়ে গ্রামের বাড়ি বরিশালের মেহেন্দীগঞ্জ থেকে সন্তানদের নিয়ে চলে আসেন নারায়ণগঞ্জে। বড় ছেলে শাকিল গার্মেন্টে ও মেজ ছেলে সজল কার্টন ফ্যাক্টরিতে কাজ করে। ছোট মেয়ে সিমুও গার্মেন্টে কাজ করতো। বাচ্চা হওয়ার পর কাজ ছেড়ে দিয়েছে। তার স্বামী জাহিদ হোসেন সোনারগাঁয়ের কাঁচপুরে একটি গার্মেন্টে কাজ করে। তিন বছর ধরে সিদ্ধিরগঞ্জের পাইনাদী নতুন মহল্লা দোয়েল চত্বর এলাকায় প্রবাসী এনায়েত উল্লার বাড়ির ৬ তলার একটি ফ্ল্যাটে ভাড়ায় বসবাস করছেন আছমা বেগম। দুই মাস আগে শ্বশুরবাড়ি থেকে মায়ের বাসায় আসে সিমু। ঘটনার দিন বাদ আসর গোলাগুলির শব্দ শুনে তিনি ৬ তলায় পশ্চিম-উত্তর দিকে তার ফ্ল্যাটের উত্তর দিকের বারান্দায় দাঁড়িয়ে বাইরের পরিস্থিতি দেখছিলেন। সিমু তার বাচ্চাকে ঘুম পাড়িয়ে বারান্দার দিকে আসতে আসতে বলে সবাই কী দেখছে, আমিও একটু দেখি। এ কথা বলে বারান্দার সামনে আসতেই উত্তর দিক থেকে একটি বুলেট বারান্দার এস এস পাইপের গ্রিল ভেদ করে সুমির মাথার বাম দিক দিয়ে ঢুকে বেরিয়ে যায়। মুহূর্তেই সে ফ্লোরে লুটিয়ে পড়ে। আছমা বেগম দৌড়ে এসে মেয়েকে জাপটে ধরে চিৎকার করে বলেন- ও মা ও মা তোমার কী হইছে। ও আল্লাগো আমার সুমির কী হইছে। মাথা থেকে রক্ত ঝরতে দেখে তিনি হাত দিয়ে সেই স্থান চেপে ধরেন। তখন সুমির নাক দিয়ে রক্ত বের হতে থাকে। সামান্য নড়াচড়ার পর সুমির আর কোনো সাড়া- শব্দ নেই। তবুও তার নিথর দেহ নিয়ে হাসপাতালে ছুটে যান স্বজনরা। সেখানে নেয়ার পর চিকিৎসক বলেন ইনি আর বেঁচে নেই।
আছমা বেগম বলেন, খাটের উপর তখনো আমার ছোট ছেলে শাহরিয়ার (১০) ও নাতি সুয়াইবা ঘুমাচ্ছে। চিৎকার শুনে তাদের ঘুম ভেঙে যায়। আমার মেয়ে একটা কথাও বলে যেতে পারেনি। মা তুমি আমার সন্তানকে দেখো, এই কথাটাও বলতে পারেনি। এ কথা বলেই কান্নায় ভেঙে পড়েন আছমা বেগম।
কাঁদতে কাঁদতে তিনি বলেন, গুলি খেয়ে পড়ে যাওয়ার পর সুমির মুখ নীল হয়ে যায়। রক্তে ভেসে যায় ফ্লোরের মেঝে। চোখের সামনে ঘরের ভেতর তাও আবার ৬ তলায় আমার মেয়ে গুলি খেয়ে মারা যাবে- এটা কীভাবে মেনে নিবো। আমার আড়াই মাসের নাতি মা-হারা হয়ে গেল। অন্ধকার হয়ে গেল তার ভবিষ্যৎ। এই বিচার কে করবে? কার কাছে চাইবো মেয়ে হত্যার বিচার?