কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে সংঘাত-সহিংসতায় নিহতদের স্মরণে আজ মঙ্গলবার দেশব্যাপী শোক পালন করা হচ্ছে। তবে রাষ্ট্রীয় এই শোক পালনকে প্রত্যাখ্যান করে মঙ্গলবার শিক্ষার্থীরা একক ও দলবদ্ধভাবে চোখে-মুখে লাল কাপড় বেঁধে ছবি তোলা এবং অনলাইনে তা প্রচার করার আহ্বান জানিয়েছেন। তাদের সেই আহ্বানের পর ফেসবুক রীতিমতো লাল রঙে ছেয়ে গেছে। দেশের সাধারণ শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে শিক্ষক, তারকারা তাদের ফেসবুক প্রোফাইল পিকচার পরিবর্তন করে ‘লাল রঙ’ বেছে নিয়েছেন।
বাংলাদেশ থেকে ফেসবুকে প্রবেশ করা যাচ্ছে না। বিকল্প উপায়ে কেউ কেউ ফেসবুক ব্যবহার করতে পারছেন। কিন্তু, ব্যবহার করতে পারলেও সকলেরই অভিযোগ ‘ফেসবুকের গতি খুবই ধীর’। তবে, এই ধীরগতির ফেসবুকেও একটি চমকপ্রদ বিষয় লক্ষ্য করছেন সবাই।
লাল রক্তে ছেয়ে গেছে ফেসবুক। কারো আইডিতে প্রবেশ করলে যেমন লাল রঙ দেখা যাচ্ছে। তেমনি, কারো পোস্ট দেখতে গেলেও চোখে পড়ছে লাল রঙ। দেশ-বিদেশের লাখ লাখ বাংলাদেশি নিজেদের প্রোফাইল পিকচার পরিবর্তন করে লাল রঙ সেঁটে দিয়েছেন।
মঙ্গলবার (৩০ জুলাই) সকাল থেকে ফেসবুকে বিভিন্ন জনের প্রোফাইল, গ্রুপ ও পেইজ ঘুরে এমন চিত্র দেখা যায়।
নির্মাতা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী তার ফেসবুক প্রোফাইল পিকচার পরিবর্তন করে লাল রঙের মাঝে মানচিত্রের একটি ছবি প্রকাশ করেছেন। যেই একই ছবি প্রকাশ করতে দেখা গেছে স্বনামধন্য গীতিকার প্রিন্স মাহমুদকেও।
এদিকে মহানগর খ্যাত নির্মাতা আশফাক নিপুণ তার ফেসবুক প্রোফাইলে পরিবর্তন এনেছেন। ‘ন্যায়বিচার বিলম্বিত, ন্যায়বিচার অস্বীকার করা’ ক্যাপশনে লাল রঙের একটি ছবি প্রকাশ করেছেন।
দেশের আরেক জনপ্রিয় নির্মাতা অমিতাভ রেজা চৌধুরী তার ফেসবুক প্রোফাইল পিকচার পরিবর্তন করে লাল রঙের ব্যানারে ‘ফুলগুলো সব লাল হলো ক্যান?’ ক্যাপশনে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছেন।
অভিনেত্রী অপি করিম তার ফেসবুক প্রোফাইলে লাল রঙের ছবি প্রকাশ করে লিখেছেন- শুধু কোটা নয়, গোটা দেশটার সংস্কার প্রয়োজন। ছোট পর্দার বর্তমান সময়ের অভিনেত্রী সাদিয়া আয়মান, তার ফেসবুক প্রোফাইলে পিকচার পরিবর্তন করে লাল রঙ বেছে নিয়েছেন।
অনলাইন শিক্ষাদান প্রতিষ্ঠান ‘১০ মিনিট স্কুল’-এর প্রতিষ্ঠাতা আয়মান সাদিক এবং একই প্রতিষ্ঠানের ইংরেজি শিক্ষিকা মুনজেরিন শহীদ তাদের ফেসবুক প্রোফাইল লাল রঙে পরিবর্তন এনেছেন।
এছাড়াও সোশ্যাল মিডিয়া ইনফ্লুয়েন্সার ‘রাফসান দ্যা ছোটভাই’সহ আরও অনেকেই তাদের ফেসবুক লাল রঙে ছেয়ে ফেলেছেন।
মুক্তিযোদ্ধা আশরাফ আলী টিপুর লাল প্রোফাইল পিকচারে লেখা, “আহারে মৃত্যু!! হায়রে স্বাধীনতা!!” বিবিসির সাংবাদিক আকবর হোসেন লাল রঙে রাঙিয়ে লিখেছেন, “পাঁচ বছর পর কাভার ফটো পরিবর্তন করলাম।”
প্রবাসীরাও পিছিয়ে নেই। সুইডেন প্রবাসী বাংলাদেশি অনিতা শফিক নিজ প্রোফাইল পিকচার লাল রঙে রাঙিয়েছেন। তিনি একটি পোস্ট শেয়ার করেছেন যেখানে “একটি অসুস্থ জেনারেশন তৈরি হচ্ছে” কে বাদ দিয়ে লেখা হয়েছে “একটি অসাধারণ জেনারেশন তৈরি হচ্ছে”।
নুসাইবা মরিয়ম সুবহা নামের জনৈক ফেসবুক ব্যবহারকারীর প্রোফাইল পিকচারে সম্পূর্ণ মুখে লাল কাপড় বেঁধে রাখা এক শিক্ষার্থীর প্রতিকৃতি।
লাকী ইসলাম লিখেছেন, “তোমাদের শোক আর অভিনয় দুটোই ভাগাড়ে মিলাক।”
যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর আলী রীয়াজও তার প্রোফাইল পিকচার লাল রঙে পরিবর্তন করেছেন। সেখানে মো. জাকির হোসেন নামে একজন মন্তব্য করেছেন, “বাঁধন ছেঁড়ার হয়েছে কাল।
হয়েছে কাল, হয়েছে কাল, হয়েছে কাল। জোয়ার এসেছে জন-সমুদ্রে।
রক্ত লাল, রক্ত লাল, রক্ত লাল।”
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হোসেন জিল্লুর রহমানও তার কাভার ফটো লাল রঙে রাঙিয়েছেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মোহাম্মদ মজিবুর রহমান প্রশ্ন করেছেন, ফুলগুলো সব লাল হলো ক্যান?
নরওয়ের অসলো ইউনিভার্সিটিতে কর্মরত বাংলাদেশি গবেষক মুবাশ্বার হাসান নিজের প্রোফাইল পিকচার লাল রঙে পরিবর্তন করেছেন যার মধ্যে একটি প্রতীকী ছবি। ছবিতে দেখা যাচ্ছে, গণতন্ত্র লেখা আকৃতির একটি মানবদেহকে হামলা করা হচ্ছে।
এর আগে সোমবার (২৯ জুলাই) রাতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে পক্ষ থেকে এক বিবৃতিতে বলা হয়, দেশজুড়ে সাধারণ শিক্ষার্থীদের যৌক্তিক দাবিকে কেন্দ্র করে নির্বিচারে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গুলিতে শত শত শিক্ষার্থীর মৃত্যু ও হাজার হাজার ছাত্র-জনতা আহত হয়ে যখন মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছে তখনো শিক্ষার্থীদের দাবি মেনে না নিয়ে একাত্তরের হানাদার বাহিনীর মতো মধ্যরাতে বাসাবাড়িতে ব্লক রেইডের মাধ্যমে নিরপরাধ শিক্ষার্থীদের তুলে নিয়ে রিমান্ডের নামে মধ্যযুগীয় কায়দায় বর্বর নির্যাতন চালানো হচ্ছে।
সমন্বয়করা বলেন, বর্তমান সরকারের কর্তাব্যক্তিরা সংকট নিরসনে শিক্ষার্থীদের দাবি মেনে না নিয়ে প্রতিদিনই নির্মমভাবে শিক্ষার্থীদের দমন-নিপীড়ন ও মানুষের জীবন থেকে রাষ্ট্রীয় সম্পদকে অধিক গুরুত্ব দিয়ে সরকারের নিয়ন্ত্রিত মিডিয়ায় প্রচার করছে এবং মিডিয়ার সামনে দেওয়া সরকারের কর্তাব্যক্তিদের মায়াকান্না প্রচার করছে।
রাষ্ট্রীয় বাহিনীর গণহত্যা ও নির্যাতনের বিচার না করে সাধারণ শিক্ষার্থীদের নিয়ে প্রতিদিন নির্মম উপহাস করা হচ্ছে। তার প্রতিবাদে শিক্ষার্থীদের দাবি আদায়ের লক্ষ্যে রাষ্ট্রীয় শোককে প্রত্যাখ্যান করে আগামীকাল (মঙ্গলবার) লাল কাপড় মুখে ও চোখে বেঁধে ছবি তোলা এবং অনলাইনে ব্যাপক প্রচার কর্মসূচি করার জন্য অনুরোধ করছি।
তারা বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ, স্কুল, মাদরাসাসহ সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী ও দেশের আপামর জনসাধারণের কাছে আকুল আবেদন জানাচ্ছি, একটি নিরাপদ বাংলাদেশ গড়তে আপনারা মঙ্গলবারের কর্মসূচি সফলে সহযোগিতা করুন। আমরা সরকারের উদ্দেশে বলতে চাই, ছাত্রসমাজের বুকে গুলি চালিয়ে বাংলার ইতিহাসে কোনো আন্দোলন দমন করা যায়নি। অবিলম্বে ছাত্রসমাজের ৯ দফা দাবি মেনে নিয়ে দেশকে স্থিতিশীল করুন।