দ্বিতীয় বারের মত শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার উদ্দেশ্যে গোছগাছ করছে ইভানা। প্রয়োজনীয় সবকিছু গুছিয়ে নিয়েছে বেশ খানিকক্ষণ আগেই। তবুও একবার চোখ বুলিয়ে নেওয়া যাকে বলে।
আলমারির একপাশে বাবার কিনে দেওয়া সাদা রঙা বার্বি ফ্রক দেখে নস্টালজিক হয়ে পড়ল। অতি যত্ন করে আগলে রাখা কাপড়ের তৈরী এক টুকরো আবেগ হাতে নিয়ে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখে মৃদুস্বরে বলল,
“কেন এত তাড়াতাড়ি বড় হয়ে গেলাম বাবা! কি হত আরও কিছু সময়, আরও কিছু বছর তোমাকে এভাবে কাছে পেলে! কি হত আরও খানিকটা সময় তোমার ছায়াতলে আশ্রয় দিলে! এ কেমন নিয়ম বাবা! যে নিয়ম বাবা মেয়েকে আলাদা করে দেয় সেই নির্দয়, নিষ্ঠুর নিয়মের বেড়াজালে তো আমি জড়াতে চাই নি। কেন জড়ালে আমায় মা? আমি তো সহ্য করতে পারছি না এই বিচ্ছেদ। দম যে আঁটকে আঁটকে আসছে। নিশ্বাসগুলো দলা পাকিয়ে যাচ্ছে। কি করে সহ্য করব আমি মা? কি করে পারলে তুমি এই মরণ যন্ত্রণা সহ্য করে সুখের সংসার সাজাতে…”
ওয়াশরুমের দরজা খোলার শব্দ পেতেই পুনরায় আলমারিতে বন্দী করল টুকরো টুকরো আবেগগুলোকে। আবরার ইভানাকে আলমারি ঘাঁটতে দেখে হঠাৎ মনে পড়ার মত বলল,
“ওহ ইভানা, তোমার প্রয়োজনীয় কাগজগুলো সাথে নিয়ে নিও আজই।”
ইভানা পেছন ফিরে ভ্রু কুঁচকে বলল,
“আজই! কেন?”
“পাসপোর্ট অফিসে যাব কাল। তোমার পাসপোর্ট বানাতে হবে তারপর ভিসার কাজের জন্যও লাগবে।”
ইভানা চমকে উঠল। ঘাবড়ে গিয়ে কাঁপা কাঁপা গলায় বলল,
“আপনি আমাকে কথা দিয়েছিলেন!”
আবরার বুঝতে না পেরে বলল,
“কি? কিসের কথা দিয়েছিলাম?”
ইভানা নিজেকে সামলাতে চোখ বন্ধ করে হাত মুঠো করে ফেলল। জোরে জোরে শ্বাস ফেলে সময় নিয়ে চোখ খুলল।
আবরারের চোখে চোখ রেখে স্থির গলায় বলল,
“আপনি কথা দিয়েছিলেন এবং এই শর্তে বিয়েটা হয়েছে যে আমি আপনার সাথে ইতালি যাব না। আপনি মেনে নিয়েছিলেন। আর মেনে নিয়েছিলেন বলেই বিয়েটা হয়েছে। নইলে পৃথিবী রসাতলে গেলেও আমি আপনাকে বিয়ে করতাম না। এখন বিয়ে হয়ে গেছে বলে আপনি কথার খেলাপ করতে পারেন না। প্রয়োজনে সব কাগজ আমি আগুনে জ্বালিয়ে দেব।”
আবরার বুকে হাত গুঁজে সরু চোখে তাকিয়ে রইল। ইভানা আকুতি মিশ্রিত গলায় পুনরায় বলল,
“আমি সত্যি যাব না। যেতে চাই না প্লিজ। একটু বুঝুন।”
আবরার দৃষ্টি সরালো না। তবে পরিবর্তন করল। সরু দৃষ্টি সময়ের পরিক্রমায় পরিণত হলো রোমান্টিক দৃষ্টিতে ।
পায়ে পায়ে এগিয়ে গেল ইভানার দিকে। ইভানার পিছিয়ে গিয়ে আলমারির সাথে সেঁটে গেল। আবরার ইভানার দুপাশে দু-হাত রেখে মাথা ঝুঁকিয়ে নিচু গলায় বলল,
“কেন মেয়ে? তুমি কি চাওনা স্বামীর সাথে দিনের পর দিন রাতের পর রাত ভালবাসায়, আলাপে, আদরে মাখামাখি করে কাটাতে? চাওনা শীতের রাতে বিড়ালছানার মত গুটিশুটি মেরে আমার তপ্ত বুকের উষ্ণতা মাখতে? নাকি চাওনা আমায় তোমার প্রেমের উষ্ণতায় ভিজিয়ে দিতে? কোনটা চাওনা মেয়ে?”
ইভানা মাথা নিচু করে চোখ বন্ধ করে রইল। আবরারের বলা প্রতিটি কথা যেমন তাকে ভেতর থেকে নাড়িয়ে দিয়েছে ; ঠিক তেমনি নাড়িয়ে দিয়েছে তার বলা প্রতিটি কথার সাথে ত্যাগ করা উষ্ণ নিশ্বাসগুলো। কানের খানিকটা নিচে এসে তপ্ত বায়ুগুলো কাঁপিয়ে দিয়েছে তার শরীর থেকে অন্তরাত্মা পর্যন্ত।
আবরার পুনরায় কিছু বলার আগেই ইভানা ঠোঁটের উপর কম্পিত হস্তের আলতো স্পর্শ করে থেমে থেমে বলল,
“আমি চাই। কিন্তু এখানে। ভিনদেশে নয়।”
প্রথম বার প্রিয়ার হাতের স্পর্শ নিজ ওষ্ঠে অনুভূত হতেই আবরার চমকে উঠল। সাথে চমকাল তার ঘন হয়ে আসা গলায় থেমে থেমে বলা কথাগুলো শুনে। সে চায়! চায় তার ভালবাসাগুলো গ্রহণ করতে। এর বেশি একজন স্বামী রূপী প্রেমিকের কি’বা চাওয়ার থাকতে পারে? কিছু না। কিচ্ছু না। আবরারের ইচ্ছে করল উড়াল দিতে। নীল আকাশের ঠিক মাঝখানটায় একজোড়া শুভ্র ডানা মেলে উড়তে।
আবরার মুখের উপর থেকে হাত সরালো। তবে ইভানার হাতটা ছাড়ল না। দু’হাতের মুঠোয় পুরে বলল,
“যদি এই নরম হাতটায় একটা চুমু দেই তুমি কি কিছু মনে করবে বউ?”
ইভানা অবাক হয়ে তাকাল। এমনও কেউ হয়! এভাবেও কেউ বলে!
আবরার ইভানার মুখ দেখে কিছু ঠাওর করতে পারল না। তাই মৃদু হেসে হাত ছেড়ে দিয়ে বলল,
“ইট’স ওকে। নো প্রবলেম।”
ইভানার হাতটা মুক্ত হতেই ইভানা ভ্রু কুঁচকে ফেলল। পরক্ষণেই কাঁপা কাঁপা হাত দুটো উঁচু করে আবরারের দিকে বাড়িয়ে দিল। আবরার প্রশ্নাত্নক দৃষ্টি নিক্ষেপ করলে ইভানা মাথা নিচু করে বলল,
“আমি বাঁধা দেই নি।”
আবরার হাসল। প্রশান্তির হাসি। কিছু পাওয়ার আনন্দ খেলে গেল তার চোখেমুখে।
দু’হাতে আঁকড়ে ধরে মাথা নিচু করে পরপর ঠোঁট ছোঁয়াল নরম কোমল হাত দুটোর উল্টো পিঠে।
ইভানা বন্ধ নেত্র যুগলে আরও কিঞ্চিৎ পরিমাণ চাপ প্রয়োগ করল। অনবরত কাঁপতে থাকা ওষ্ঠ যুগল চেপে ধরল একে অপরকে। হাতের নিচে বিরাজমান শক্ত পোক্ত হাত দু্টোকে খামচে ধরে নিজের ভেতরে চলা অনুভূতির জানান দিল স্বামী নামক মানুষটিকে।
“নোভা! নোভা! কোথায় তুই?”
রিফাতের চিন্তিত কণ্ঠ শুনে নোভা তাড়াহুড়ো করে বিছানা ছেড়ে উঠে বসল। হুরমুর করে ওঠে দরজা খুলে বলল,
“রিফাত ভাই, কি হয়েছে?”
রিফাত কড়া গলায় বলল,
“দরজা বন্ধ করে কি করছিলি তুই?”
ড্রেসআপ দেখে ভ্রু কুঁচকে বলল,
“এখনো এভাবে কেন তুই? বাড়ি ফিরবি না? আজও এখানেই থাকতে চাচ্ছিস নাকি?”
নোভার দুঃখে নিজের কপাল চাপড়াতে ইচ্ছে করছে। ছেলেটা কিছু বলার সুযোগই দিচ্ছে না। বাধ্য হয়ে দরজার কাছ থেকে সরে গিয়ে বিছানায় ধপাস করে বসে পড়ল। রিফাত তৎক্ষণাৎ ছুটে এসে গালে কপালে হাত ছুঁয়ে বলল,
“কি হয়েছে তোর? জ্বর বাঁধিয়েছিস? কই তখন তো ছিল না।”
নোভা আয়েস করে বসে বলল,
“কখন রিফাত ভাই?”
“ওই তো যখন তুই আমাকে জড়ি…না কিছু না। যাইহোক জ্বর তো আসে নি। তাহলে চোখ মুখ লাল হয়ে আছে কেন?”
নোভা রিফাতের কথা কানে না তুলে নিজের মত বলল,
“আজ আমাকে তোমার বুকে আশ্রয় দিয়েছিলে রিফাত ভাই। যেখানটায় মাথা রেখে আমি সারাজীবন কাটানোর স্বপ্ন দেখি। আজ আমি আমার স্বপ্ন ছুঁয়েছি রিফাত ভাই। আমার জন্য আজ ঈদ। ঊনত্রিশ রোজার শেষে হওয়া ঈদের আনন্দ হচ্ছে আমার। ঊনত্রিশ রোজা কেন বললাম জানো রিফাত ভাই? ত্রিশ রোজার শেষে যে ঈদ আসবে এটা সবাই জানে। কিন্তু ঊনত্রিশ রোজার শেষে ঈদটা অপ্রত্যাশিত আনন্দের। আমার কাছে আজকের প্রাপ্তিটা অপ্রত্যাশিত। যদিও আগের ঘটনাটা নিকশ কৃষ্ণ আঁধার।”
কিছুটা সময় থেমে দম নিয়ে পুনরায় বলল,
“জানো রিফাত ভাই, আমার মনে হচ্ছিল আমি বোধহয় মরে যাব আজ। আর বেঁচে গেলেও ছাদ থেকে লাফিয়ে নিজের অতি মূল্যবান প্রাণটা বিসর্জন দিতে হবে। ভেবেছিলাম হয়তো আর তোমার এই বিরক্তি মাখা মুখটা দেখতে পাব না। দাদাভাই কে দাদাভাই বলে ডাকতে পারব না। মা’য়ের বুকেও আর ফেরা হবে না। কিন্তু যখন দিশেহারা আমি বাঁচার পথ খুঁজছিলাম ঠিক তখনই দূত হয়ে তুমি এলে। তোমার অতিপরিচিত ভরাট কন্ঠের শব্দ শুনে আমি দেহে প্রাণ ফিরে পেয়েছিলাম। তখন তুমি না এলে হয়তো এতক্ষণে আমার লাশ নিয়ে বাড়ি ফিরতে।”
হঠাৎ করেই রিফাত রেগে গিয়ে বলল,
“চড়িয়ে গাল লাল করে দেব বেয়াদব মেয়ে।”
নোভা হাসল। চওড়া হাসি।
রিফাত ভ্রুকুটি করে বলল,
“পাগলের মত হাসছিস কেন?”
নোভা পুনরায় হাসল। খানিক বাদে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে নমনীয় গলায় বলল,
“বলে দাও না ভালবাসো।”
রিফাত চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে রইল কিছু সময়। পরক্ষণেই গলা ঝেড়ে বলল,
“তোকে বলেছিলাম আমার গার্লফ্রেন্ডের কথা। নোরা। ও আসবে কয়েকদিনের মধ্যেই। এলে তোর সাথে পরিচয় করাব। তাহলে তোর ভুল ধারণা ভাঙবে।”
নোভা সরু দৃষ্টিতে তাকাল। তাকিয়ে থাকা অব্যাহত রেখে বলল,
“আমি রেডি হব। তোমার গার্লফ্রেন্ড নিশ্চয়ই চায় না তুমি অন্য মেয়ের চেঞ্জ করা হা করে গিলো। সেটাও আবার তোমার অর্ধেক বয়সী একটা মেয়ে।”
“তোমার স্বামী ভিনদেশে কোনো ভিনদেশিনীর সাথে সংসার পেতেছে কি-না সেটা দেখার জন্যও তোমার একবার যাওয়া উচিত কাঁচাগোল্লা।”
ইভানা ভ্রু উঁচিয়ে বলল,
“ভিনদেশিনী! আচ্ছা! কি ভেবেছেন? এটা বললে আমি সুরসুর করে চলে যাব? কখনো না। যাব না আমি।”
আবরার মুচকি হেসে বলল,
“তিন মাসের জন্যও না? বছরে তিনটি মাস? আমার জন্য। প্লিজ! বাকি নয় মাস তোমার দেশ কে দাও। পরিবার কে দাও। তিনটে মাসও কি আমার প্রাপ্য নয়?”
“আপনার সারাজীবনই প্রাপ্য। কিন্তু এভাবে কিভাবে? আমি বুঝতে পারছি না।”
“আমি ছ’মাস পরপর আসতে পারব। সেটাও মাত্র পনেরো দিন। বছরে ত্রিশ দিনে তো আমার তোমাকে দেখেই মন ভরবে না। বাকিগুলো তো দূর আসমানে। কিন্তু তুমি যদি যাও তিনমাসের জন্য যেতে পারবে। সারাবছর না হলেও চারভাগের এক ভাগ পেয়েই না-হয় আমি সুখী হলাম। যাবে?”
ইভানা মাথা নোয়ালো। মৃদুস্বরে বলল,
“আপনি খুশি হবেন?”
আবরার একপ্রস্ত হেসে বলল,
“বাঁধভাঙা খুশির জোয়ারে ভাসব।”
ইভানাও হাসল। বলল,
“তবে তাই হোক।”
রিফাত বারান্দায় দাঁড়িয়ে মৌনতাকে বরণ করে নিয়েছে। কিন্তু মন মস্তিষ্কে চলছে অহরহ কথাবার্তা, ভাবনা। সকালে ইভানা আবরারের সাথে বের হওয়ার পর নোভাকে না দেখে শরীর খারাপের দোহাই দিয়ে ফিরে আসে। বাসায় ঢুকে নোভার খোঁজ করতে করতে ছাদে গিয়ে পৌঁছায়। সেখানেই বিধ্বস্ত অবস্থায় পায় তাকে। তখনকার ঘটনাগুলো চোখের পর্দায় ভেসে ওঠতেই চোয়াল শক্ত হয়ে উঠল তার। এত যত্নে বেড়ে ওঠা ফুলে স্পর্শ করে কলঙ্কিত করতে চাওয়ার অপরাধে আরও কয়েক প্রস্ত আঘাত করতে ইচ্ছে করছে কালপ্রিটটাকে। ছোট্ট ফুলটার হুহু করে কান্নার শব্দগুলো এখনো বোধহয় দূর দুরান্ত থেকে ভেসে আসছে কর্নকুহরে। রিফাত কানে হাত চেপে ধরল। অসহনীয় যন্ত্রণায় ছটফট করতে লাগল একাকী, নীরবে।
একদিন বাড়ির বাইরে থেকে হাঁপিয়ে উঠেছে নোভা। নিজ বাসায় পৌঁছেই ড্রয়িং রুমের সোফায় গা এলিয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলল। মূহুর্তেই ভেসে উঠল সেই প্রশস্ত বুকের মালিকের মুখটা। নোভার চোখে সুদর্শন পুরুষের মুখ। কানে ভেসে এলো সেই শব্দগুলো- কিচ্ছু হয় নি পিচ্চি। তাকাও আমার দিকে। শান্ত হও।
ফট করে চোখ খুলে ফেলল। পাশেই ফাহিমা করিম কে দেখে গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
“আমি বিয়ে করতে চাই মা।”
ড্রয়িং রুম ক্রস করে এগিয়ে যাওয়া তিনজোড়া পা থমকে গেল। আবরার ইভানা অবাক হয়ে তাকালেও রিফাত তাকাল বিস্ফোরিত নয়নে।
ফাহিমা করিম অবিশ্বাস্য কণ্ঠে বললেন,
“কি বললে?”
নোভা পুনরায় বলল,
“আমি বিয়ে করতে চাই।”
সেদিন_বসন্ত_ছিল
রাহনুমা_রাহা
পর্বঃ২০
“মাথা ঠিক আছে তোমার নোভা? কি বলছো ভেবে বলছো তো?”
মায়ের গম্ভীর কণ্ঠ শুনেও নোভা নিজের সিদ্ধান্তে অটল রইল।
স্থিরচিত্তে বলল,
“আমি ভেবেচিন্তেই বলছি মা।”
ফাহিমা করিম নিজের মাথা যথেষ্ট ঠান্ডা রেখে বললেন,
“বয়স কত তোমার? আঠারো পেরিয়েছে কি? এখনই বিয়ের এত তাড়া কিসের? কে বিয়ে করবে তোমাকে? শুধু সুন্দর চেহারা দেখে কোনো ব্যক্তিত্ববান মানুষ তোমাকে বিয়ে করতে আসবে না। সুন্দরী ছাড়া আর কোনো যোগ্যতা আছে তোমার বর্তমানে? শুধুমাত্র এসএসসিতে ভালো রেজাল্ট কোনো মেয়ের যোগ্যতা প্রমাণ করতে পারে না।”
নোভা দমে গেল না। বরং অধৈর্য হয়ে বলল,
“প্রয়োজনে রিকশাওয়ালা, ভ্যানওয়ালা,সবজিওয়ালা যে কারো সাথেই বিয়ে দিতে পারো। আমি টু শব্দটিও করব না। তারাও যদি বিয়ে করতে রাজি না-হয় তবে রাস্তা থেকে ভিখিরি ধরে নিয়ে এসো। বিয়ের পর একসাথে রাস্তার মোড়ে মোড়ে ভিক্ষা করব। সুন্দর চেহারা দেখে মানুষের মন গললে নিশ্চয়ই ভিক্ষা দেবে। তোমরাও না-হয় যেতে আসতে দু-এক পয়সা দিও। এতটুকু যোগ্যতা নিশ্চয়ই আমার আছে।”
ফাহিমা করিম হতবাক হয়ে মেয়ের বলা বাক্যগুলো গিলল।
আবরার হাঁটু গেড়ে বসে নরম গলায় বলল,
“কি হয়েছে বাবু? এভাবে উল্টাপাল্টা বকছিস কেন? কেউ কিছু বলেছে? দাদাভাইকে বল। চামড়া ছিঁলে লবণ লাগিয়ে দেব।”
নোভা ঠোঁট বেকিয়ে হাসল।
আবরার পুনরায় বলল,
“বল না বোন আমার। কে কি বলেছে?”
নোভা উঠে দাঁড়িয়ে পড়ল। আবরার কে উদ্দেশ্য করে বলল,
“তুমি আমার বিয়ে দিয়ে তবে বাড়ি থেকে বের হবে। নইলে আমি তোমাকেও যেতে দেব না।”
“আচ্ছা বেশ। মেনে নিলাম। কিন্তু কাকে বিয়ে করতে চাও, সেটা তো বলো।”
নোভা আড়চোখে একবার রিফাতের দিকে তাকাল। বেচারার মুখ শুকিয়ে গেছে। ভয়ে, আতঙ্কে বাঁ’হাতে মুখ চেপে ধরে দাঁড়িয়ে আছে।
নজর ফিরিয়ে আবরারের দিকে মনোনিবেশ করে বলল,
“আমার কোনো পছন্দ নেই দাদাভাই। যাকে পাও তার সাথেই বিয়ে দিয়ে দাও। তবে দেখবে ছেলে যেন রাজপুত্র না হয়। লোকে বলে আমি নাকি রাজপুত্র ডিজার্ভ করি। তাদের দেখিয়ে দিতে চাই রাজপুত্র নয়, সাধারণ একটা মানুষ ধরে এনেছে আমার দাদাভাই। তাকে নিয়েই আমি ভাল আছি। ভালো থাকতে পারি।”
আবরার হতবিহ্বল হয়ে মায়ের দিকে তাকাল। ইশারায় বোঝালো-কি হয়েছে?
ফাহিমা করিম মাথা নেড়ে বোঝালেন তিনি কিছু জানেন না।
“আপনি নোভার ব্যাপারটা নিয়ে ভাবছেন কিছু?”
পিনপতন নীরবতার অন্তিমকাল উপস্থিত হলো ইভানার রিনরিনে কণ্ঠস্বরে।
আবরার তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে বলল,
“ভাবছি। ব্যাপারটা ভাবতে বাধ্য করছে। নোভা তো বাচ্চা নয়। বয়স খুব একটা না হলেও সে ম্যাচিউর। এরকম কথাবার্তা বলা ওর স্বভাব বিরুদ্ধ। বুঝতে পারছি না হঠাৎ এরকম ব্যবহারের কারণ। অবশ্য আমার বুঝার কথাও নয়। আমি তো আমার বাচ্চা নোভাটাকে রেখেই বিদেশে পাড়ি জমিয়েছিলাম। ওর বেড়ে ওঠা, সময়ের সাথে সাথে পরিবর্তন কিছুই কাছ থেকে দেখতে পারিনি। মা’কে বললাম, মাও কিছু বুঝতে পারে নি।”
খানিকটা দম নিয়ে বলল,
“তুমি একটু দেখবে প্লিজ? শুনেছি মেয়েরা নাকি ভাবীদের কাছে মনের কথা শেয়ার করে। দেখবে? সাহায্য করবে তো আমায়?”
ইভানা চোখ ছোট ছোট করে তাকাল।
“আমি আপনাদের কেউ নই তাই না? পরের বাড়ির মেয়ে কিনা। নোভাও নিশ্চয়ই আমার কেউ না, তাই না? সেজন্য এভাবে বলছেন। নোভা আমার নিজের বোন হলে তখনো এভাবে বলতেন?”
আবরার চকিতে তাকিয়ে বলল,
“আমি এভাবে বলিনি। তুমি ভুল করছো। ভুল ভাবছ। ভুল বুঝছো আমাকে। তুমি আমার মানে আমি তোমার। আমি তোমার মানে আমার পরিবারও তোমার।”
ইভানা তবুও দৃষ্টি সরিয়ে নিল। অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে রইল।
আবরার মুচকি হেসে ইভানার নাক টিপে দিল। কাছাকাছি এসে দাঁড়িয়ে নিচু গলায় বলল,
“আদর দিয়ে মান ভাঙাব?”
ইভানা লাফিয়ে দূরে সরে গেল। হড়বড় করে বলল,
“আমি নোভা কে দেখে আসছি।”
বলেই এক ছুটে বাইরে বেরিয়ে গেল। আবরার পেছনে কুঞ্চিত ভ্রু যুগল সোজা করতে ব্যস্ত।
নোভা কম্বল মুড়ি দিয়ে বই পড়ছে। পুরোটা ভেতরে ঢুকে কেবল মুখটা বের করে রেখেছে। শীতকালটা তার এভাবেই কাটে। পৌষের পুরো সময়টা সে আপাদমস্তক কাপড়ে আবৃত হয়ে ঘুরে বেড়ায়। শীতে কাবু হওয়ার দরুন ছোট থেকেই তাকে প্রায় তুলোয় মুড়িয়ে রেখেছেন ফাহিমা করিম।
নোভা দরজা নক করে বলল,
“আসব নোভাপু?”
নোভা মাথা উঁচু করে বলল,
“এসো ভাবি। অনুমতি নিতে হয় নাকি।”
ইভানা ভেতরে এসে নোভা কে দেখে হেসে বলল,
“ওরে বাপরে! তুমি তো এখনই প্যাকেট হয়ে গেছো। এরপর কি করবে? আরও শীত আসলে তখন?”
নোভা ঠোঁট প্রসারিত করে হাসল। ইভানা অনিমেষ তাকিয়ে দেখল বিদেশিনী মেয়েটির মুগ্ধ করা হাসি।
“শীতের সময় আমার চোখগুলো ছাড়া একটা লোমও দেখতে পারবে না তুমি ভাবী।পারলে চোখেও মোজা পরতাম আমি। তখন কিভাবে পড়ি জানো? আমি পুরোটা কম্বলের ভেতরে চলে যাই। তারপর কম্বলের ভেতর লাইট নিয়ে বই নিয়ে পড়ি।”
ইভানা মুচকি হেসে বলল,
“গোসল করো তো? নাকি সেটাও শীতের আগে একবার আর শীতের পরে একবার?”
“ওফ ভাবী তুমি আমায় খেপাচ্ছাে। গোসল রোজই করি। গরম পানি আছে তো।”
ইভানা আরও কিছুক্ষণ কথা বলে নোভার মনের অবস্থা বুঝার চেষ্টা করল। তবে এরমধ্যে একবারও নোভা বিয়ে সম্পর্কিত প্রসঙ্গ তুলে নি। ইভানাও নিজে থেকে কিছু বলল না।
“কিছু বলল?” নোভার রুম থেকে ফিরতেই উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল আবরার।
নোভা ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়ে আবরারের মুখোমুখি সোফায় পা তুলে বসল। আবরার পুনরায় বলল,
“কিছু বুঝতে পারলে?”
ইভানা আয়েশ করে বসে বলল,
“নোভা ঠিক আছে। সমস্যা খুব একটা জটিল বলে মনে হলো না। তবে অবশ্যই সে একটা সমস্যার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। আপনি একটু খেয়াল রাখুন ওর। প্রয়োজনে ক্লাস, কলেজের দিকে নজর রাখুন। আজকাল তো আবার সেখানে ঝামেলার শেষ নেই। “
আবরার মাথা নাড়ালো।
“উইল ইউ বি মাই গার্লফ্রেন্ড?”
ইভানা চকিতে তাকালে আবরার মুচকি হেসে বলল,
“বৈধ গার্লফ্রেন্ড। হবে? প্লিজ!”
ইভানা হাই তুলে দু-হাত দুদিকে মেলে দিতেই আবরার সরু চোখে তাকিয়ে বলল,
“প্রথম দিনেই হাগ করতে চাইছো?”
ইভানা হাই তোলা হা করা মুখ অকস্মাৎ বন্ধ করে ফেলল। বিস্মিত গলায় বলল,
“সিরিয়াসলি? এটাই মনে হলো আপনার? হাই তুলছিলাম আমি।”
আবরার ঠোঁট কামড়ে হাসল।
“হাগ করতে চাইলেও আমি কিছু মনে করতাম না। একমাত্র গার্লফ্রেন্ড বলে কথা।”
“এত তাড়াতাড়ি? মাত্র তো প্রপোজ করলেন। একটু ঝুলে থাকুন। আমি সময় নেই। ভাবি। ভাবতে ভাবতে দিকবিদিক ভুলে যাই। তবেই না সময় হবে উত্তর দেওয়ার।”
“তখন উত্তর টা হ্যা হবে তো?”
“সেটা তো সময় বলবে বেবস্।”
আবরার চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে বলল,
“বেবস্! সেটা আবার কি?”
ইভানা চমৎকার হাসল।
আবরারের নাক টিপে দিয়ে বলল,
“আমার মাথা আপনার মুন্ডু।”
ঘড়ির কাঁটা একটার ঘন্টা পেরিয়েছে মিনিট দশেক আগে। গভীর ঘুমে মগ্ন পৃথিবীতে জেগে আছে কিছু রাতজাগা নিশাচর প্রাণী। আর কিছু মনুষ্য প্রজাতি। যাদের রন্ধ্রে রন্ধ্রে বয়ে চলেছে ভালবাসা নামক অনুভূতি। প্রেমের অনলে দগ্ধ হচ্ছে ক্ষণে ক্ষণে।
খুট করে দরজা খোলার শব্দ পেয়ে নোভা চকিতে তাকাল। ড্রিম লাইটের আবছা রোশনাইয়ে কল্প পুরুষ কে দেখতে পেয়ে তৎক্ষণাৎ ওঠে বসল। রিফাত দরজা বন্ধ করে দ্রুত পায়ে এগিয়ে এসে বিছানার কাছাকাছি দাঁড়াল। কম্বল টেনে সরিয়ে দিতেই নোভা অল্প আওয়াজে বলল,
“কি করছো রিফাত ভাই?”
রিফাত উত্তর দিল না। পুরুষালী শক্তি প্রয়োগ করে কম্বল টেনে সরিয়ে ফেলল। নোভা পুনরায় নিজেকে আবৃত করতে চাইলে বিছানা থেকেই ছুঁড়ে ফেলে দিল।
নোভা বিস্মিত গলায় বলল,
“পাগলামি করছো কেন রিফাত ভাই? তুমি তো চলে গিয়েছিলে সন্ধ্যায়। এখন কিভাবে এলে?”
রিফাত বিছানায় বসে শক্ত থাবায় নোভার বাদামী রঙা চুলের গোছা ধরে বলল,
“আমি পাগলামি করছি? তুই কি করছিলি তখন?”
নোভা চোখ বন্ধ করে ফেলল। রিফাতের হাত আলগা করার চেষ্টা করে বলল,
“রিফাত ভাই লাগছে আমার। ছাড়ো প্লিজ।”
রিফাত ছাড়ল না। বরং আরও খানিকটা চেপে ধরে মুখ বরাবর নোভার মুখ এনে বলল,
“এখন লাগছে! আমাকে যে তখন থেকে আঘাত করেই যাচ্ছিস, তার বেলায়?”
নোভা চোখ খুলল। ব্যথার মাঝেও মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল,
“তাই! তোমারও লাগে নাকি? আমি তো ভেবেছিলাম তুমি রোবট।”
রিফাত দম নিল। হাতের বাঁধন থেকে চুলের গোছা আলগা করে দিল। গলদেশ থেকে কাঁপা কাঁপা হাতটা চিবুক স্পর্শ করল। তীব্র পুরুষালী কঠিন স্বরটা খাদে নামিয়ে বলল,
“আমার কি হবে?”
নোভা কেঁপে উঠল। ভেতরে অবস্থায়মান নারী সত্তাটাও নড়ে উঠল। কিন্তু সেসব বাইরে প্রকাশ না করে ভাবলেশহীন গলায় বলল,
“তোমার কিছুই হবে না রিফাত ভাই। আমার হবে। বিয়ে করব, বাসর হবে। বছর ঘুরতেই বাচ্চা হবে। একে একে বছর গড়াতে থাকবে আর সেই হিসেবে বাড়তে থাকবে আমার বাচ্চার সংখ্যা।”
নরম কোমল রিফাত পুনরায় অগ্নিমূর্তি ধারণ করল। তিন আঙুলে গাল চেপে ধরে বলল,
“আমি ছাড়া তোকে কেউ ছোঁবে না। কেউ না।”
নোভা মুচকি হাসল। বলল,
“ছোঁবে। একশবার ছোঁবে হাজার বার ছোঁ…”
পুরো কথাটা শেষ করার আগেই মুখটা অটোমেটিক বন্ধ হয়ে গেল। নাহ! মুখ বন্ধ হয় নি। বন্ধ হয়েছে কণ্ঠস্বর। কালচে ঠোঁটের উষ্ণ স্পর্শে কেঁপে কেঁপে উঠল গোটা শরীর। কিন্তু সময় পেরোতেই গলদেশের ফর্সা চামড়াটুকু পিষ্ট হলো ঠোঁটের চাপে। দগ্ধ হলো উত্তপ্ত নিশ্বাসের তাপে। কণ্ঠদেশে তীব্র জ্বলন অনূভুত হতেই অস্ফুটে বলল,
“জ্বলছে রিফাত ভাই।”
কানে তুলল না বোধহয় সে। তাই তো জ্বলনটা তীব্র থেকে তীব্রতর হতে শুরু করল। যার দরুন কণ্ঠনালী বেদ করল তার আর্তচিৎকার।